ফ্রেডরিক জেমসনের জন্য, মার্কসবাদী সমালোচনা ছিল ভালোবাসার শ্রম
২২শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার। ৯০ বছর বয়সের সাহিত্য সমালোচক ফ্রেডরিক জেমসন মারা গেলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন "পাঠই বিপ্লবের পথ"।
নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত
২২শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার। ৯০ বছর বয়সের সাহিত্য সমালোচক ফ্রেডরিক জেমসন মারা গেলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন "পাঠই বিপ্লবের পথ"।
ইংরেজিভাষী বিশ্বে সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালী মার্কসবাদী সাহিত্য সমালোচক ছিলেন। ভিন্নভাবে বললে, তিনি ছিলেন এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব; প্রান্তিক-জনগোষ্ঠী বিষয়ে ক্রমশ সুপরিচিত হয়ে উঠছিলেন— বলা যায়, শ্রদ্ধেয়। আমার কথায় এ বিষয়ে গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে না বরং এর অবয়ব তুলে ধরছি।
জেমসন, ১৯৮৫ সালে ডিউকে যোগদানের আগেই হার্ভার্ড, ইয়েল এবং সান্তা ক্রুজে পড়ানোর সুবাদে পণ্ডিত মহলে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন; এককথায় নিজস্ব বিষয়ে সুপণ্ডিত। তবে কখনো জনপ্রিয় বুদ্ধিজীবী হওয়ার চেষ্টা করেননি; অনুপস্থিত থাকতেন টেলিভিশন বা পত্র-পত্রিকায়। যদিও তাঁর মনোযোগী লেখায় সুসংহত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যেত। স্টেনফোর্ডের অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক মার্ক গ্রিফের মতে, তিনি মার্কসবাদী সাহিত্য সমালোচক হলেও কোন বিষয়ে ছিলেন না— গোঁড়া, দাম্ভিক বা একনিষ্ঠ ভক্ত।
মার্কসবাদকে তিনি কেবল দর্শন, সাহিত্যকর্ম বা চলচ্চিত্রকে বিশ্লেষণ (পরিসংখ্যান ও নৈতিক) করার কোনো হাতিয়ার হিসাবে দেখতেন না, বরং তিনি মনে করতেন মার্কসবাদ আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের একটি ব্যবস্থা। তার মতে, সাহিত্য বা চলচ্চিত্র শুধুমাত্র ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ নয়, বরং তা বিদ্যমান সমাজের ভারসাম্যের প্রতিরূপ। তার লেখা বা গবেষণায় থাকতো এই ভারসাম্যের অনুসন্ধান, সাথে থাকতো বিনির্মাণের ব্যবস্থাপত্র।
জেমসন বিপ্লবী হিসেবে পরিচিত হলেও, তিনি একইসাথে একজন প্রথাগত চিন্তাবিদও ছিলেন। লেখায় জটিল ভাষা ব্যবহার, অসংখ্য উদ্ধৃতি ও সূত্র তাঁর বিস্তৃত পাঠের পরিচায়ক। বিভিন্ন বিষয়ে লিখলেও মূলত ১৯ ও ২০ শতকের ইউরোপীয় সাহিত্যের উপর বিশেষ করে ফ্লবেয়ার, মালার্মে, জয়েস ও মানের গভীরভাবে গবেষণা করেছেন।
বালজাক হতে ফ্লিপ কে. ডিক, সার্ত্র হতে সাইবারপাঙ্ক, প্রুস্ট হতে পপ আর্ট—— ভিন্ন ধরনের সাহিত্য ও শিল্পের প্রতি জেমসনের ছিল উৎসাহী ও অনুসন্ধানী দৃষ্টি। পছন্দের শিল্পী-সাহিত্যিকের প্রতি গভীর আকর্ষণ থাকলেও, লেখায় ছিল না পক্ষপাত-দুষ্টের কোনো চিহ্ন। যেমন, জেমস জয়েসের "উলিসিস" উপন্যাসের সবচেয়ে বিরক্তিকর অংশগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা তিনি করেছেন বা লেখক উইন্ডহ্যাম লুইসের উপর একটি পুরো বই লিখেছেন। বলতে চাইছি, সর্বপরি তিনি একজন সমালোচক।
জেমসন কেন সমালোচক হিসেবে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই। পুঁজিবাদের এ যুগে আমি এবং আমার সহকর্মীরা যে ধরনের সমালোচনা করার চেষ্টা করেছি জেমসনের সাথে তার মিল পাই।
জেমসনের লেখায় রূপক, উদাহরণ এবং বিভিন্ন ধরনের শৈলী মেশানো অনেক জটিল ও দীর্ঘ বাক্য আছে। আবার লেখায় মাত্র দু শব্দের ছোট বাক্যও আছে, যা এতটাই অনুপ্রেরণাদায়ী যে আমি তা ট্যাটুও করতে চাই।
১৯৮১ সালে প্রকাশিত জেমসনের ‘দ্য পলিটিক্যাল আনকনশাস’ বইয়ের প্রথম বাক্য "সর্বদা ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করুন", বাক্যটি পুরো বইয়ে সামাজিক-প্রতিরূপ হিসেবে বিবেচিত; বা আমরা বলতে পারি এই বাক্যটিকে দ্বান্দ্বিক-চিন্তার অপরিহার্য ও ইতিহাসের রূপান্তর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বইয়ের শুরুর মুখবন্ধের পাতা থেকেই মনে হতে পারে বইটি জটিল, প্রকৃতপক্ষে আগ্রাশী বিমূর্ত ভাষা, অকপট নৈতিকতা এমনকি সংবেদনশীলতাই এর সৌন্দর্য্য।
আপনি পেশাদার সমালোচক হোন বা না হোন, তার কাজ হল মানব কল্পনার যেকোনো রচনার অর্থ খুঁজে বের করা— তা কবিতা, চিত্রকর্ম, খাবার বা ডকুমেন্টারি যাই হোক; এর অর্থ ও মূল্য কী, তা বুঝতে হলে এর উৎপত্তি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কে এটি তৈরি করেছে, কেন তৈরি করেছে এবং কী পরিস্থিতিতে তৈরি করেছে, এই তথ্যগুলো খুঁজে বের করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এসব সরাসরি মার্কসবাদী প্রশ্ন না হলেও, এই প্রশ্নগুলো থেকে শুরু করে আমরা ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে মার্কসবাদের মতো উপসংহারে পৌঁছাতে পারি। একটা প্রেমের কবিতা বা এক প্লেট পাস্তা হোক, সবকিছুই সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় এবং অন্য অনেক কিছুর সাথে সম্পর্কিত। যেমন, ছোটবেলায় পড়া শেক্সপিয়ারের সনেটের অর্থ মধ্যবয়সের আর এক থাকে না। শতাব্দীর ভিন্নতায় একই জিনিসের অর্থের ভিন্নতা দেখা দেয়। আবার, রবিবারে দাদির হাতের রান্না পাস্তা আর বাইরে অর্ডার করা পাস্তার স্বাদ ও অর্থ এক নয়।
এই সামাজিক-ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করা এবং এর পরিবর্তনগুলো অনুসরণ করাকে জেমসন নাম দিয়েছেন "দ্বন্দ্বমূলক চিন্তা"। এটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য কাজ। আপনার রাতের খাবারের ঐতিহাসিকমূলক বিশ্লেষণ করতে হলে আপনাকে মার্কো পোলোর ভ্রমণ, টমেটোর ইউরোপীয় আগমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতালীয় অভিবাসীদের কাহিনী এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস কুকিং অ্যাপের উদয় সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে। সন্দেহাতীত ও যথার্থভাবে বলতে গেলে, স্টার্টার (খাবারের) ছাড়া কোনো মূল পদ (খাবারের) নেই; প্রথম কোর্স ছাড়া কোনো দ্বিতীয় কোর্স নেই; মূল খাবার ছাড়া মিষ্টান্ন নেই; এগুলোও অনুসন্ধান করতে হবে। এবং আমরা এখনও গমের আমিষ বা টুকরো পারমেসান(পনির) বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করিনি অথবা আরও গুরুত্ব দিয়ে বলতে গেলে— ভোক্তা অর্থনীতিতে খাদ্যের অসম বণ্টন।
স্বাগতম দ্বান্দ্বিকতায় বা নৈতিকতায়! বুয়োন অ্যাপেতিতো (মজা করে খান)! জেমসনীয় পদ্ধতির এই উপহাসের উদ্দেশ্য মেধাকে খাটো করা নয়, বরং তার কিছু ধারণাকে সহজতর করা। (ট্রান্সকোডিং; ডিমিস্টিফিকেশন; কগনিটিভ ম্যাপিং শব্দগুলো সবই জেমসনের শব্দভাণ্ডারের অংশ) তবে তাকে পড়া কখনোই সহজ হতে পারে না: সমালোচনাকে তিনি যেভাবে বুঝতেন— বিষয়বস্তুর জটিলতা, বারংবার প্রক্রিয়াকে পর্যালোচনা, পরিশোধন এবং পদ্ধতিকেই প্রশ্ন করার কারণে।
আমার মতে, জেমসন ছাড়া এত নিষ্ঠার সাথে আর কেউ এই কাজটি করেছে— বা দ্বান্দ্বিকভাবে কি বলা যায়, এত স্পষ্টভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ঝুঁকি নিয়ে জেমসন ছাড়া আর কেউ সম্পন্ন করেননি।