আখের স্বাদ নোনতা
মলি আহমেদ | এক সময় পলিটিক্যাল বই খুব পড়তাম সে আমার কিশোরী জীবনের শুরুতে, যদিও লুকিয়ে হোক বা চুরি করে হোক পুরো শরৎচন্দ্র শেষ করেছি সেই সময়। ভালো লাগত ম্যক্সিম গোর্কি, হো চি মিন্ এর জীবন কথা, চে গুয়েভা
বয়স একটা পরম ব্যপার। এর সাথে সাথে বদলায় মন, বদলায় চিন্তা, শুরু হয় অভিজ্ঞতা আর অনভিজ্ঞতার লড়াই, পাল্টে যায় প্রাধান্য পাবার বিষয় গুলো। পছন্দ আর অপছন্দের দ্বন্দ্বে আসে সংঘাত, যা ভালো লাগতো তা আর ভালো লাগে না, আর যা ভালো লাগতো না সে এসে জুড়ে বসতে চায় মনে। ফিরে দেখতে চাইলে মোটামুটি সে এক বিশাল প্রান্তর, যার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত উথালিপাথালি টেউয়ের মেলা।
এক সময় পলিটিক্যাল বই খুব পড়তাম সে আমার কিশোরী জীবনের শুরুতে, যদিও লুকিয়ে হোক বা চুরি করে হোক পুরো শরৎচন্দ্র শেষ করেছি সেই সময়। ভালো লাগত ম্যক্সিম গোর্কি, হো চি মিন্ এর জীবন কথা, চে গুয়েভারা, কিউবার সংগ্রাম। বলিভিয়ার নির্যাতিত মানুষের দীর্ঘশ্বাসে কেঁদেছি কত। সেই সময় সেই সব বইগুলি মনকে কোথায় নিয়ে যেত। “Uncle Tom's cabin”, “To kill a Mockingbird”, “The Adventures of Tom Sawyer” এ সব পড়তে পড়তে কখন বই পড়া একটা নেশা হয়েছে জানি না।
Classic Comic ও পড়েছি প্রচুর আর সেসব পড়তে দারুণ মজা পেতাম। অনেক ছোটো থাকতে শুরু করেছিলাম 'শুকতারা' আর একটা ম্যাগজিন বই Sputnik, কী বিশাল আনন্দ ছিল সেই সব বইয়ের ভিতর। ছোটোবেলায় মা আমাকে 'ঠাকুর মা'র ঝুলি' থেকে গল্প পড়ে শুনাতো, সেই সময় আমার মন কত রঙিন প্রজাপতি হয়ে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়িয়েছে।
প্রলেতারিয়েত মানুষের কথা যখন জেনে ছিলাম, মনটা সম্পূর্ণ একটা অন্য জগত খুলে দিয়েছিল আমার সামনে। “তেতো কফি”, “আখের স্বাদ নোনতা”, “দুনিয়া কাঁপান দশদিন”, “Good Earth”, Maxim Gorky’র “মা” , “চে'র ডাইরী” এমনি কত কত বই ..... সর্বপরি এই সব বইয়ের মাঝে ছিল আমার রবীন্দ্রনাথ পড়া।
সত্তর দশকের প্রথম দিকে ঢাকায় খুব একটা বইয়ের দোকান ছিল না। নীলক্ষেতের ওখানে আর নিউমার্কেটে কিছু বইয়ের দোকান ছিল। বালাকা সিনেমা হলের নীচে 'বই পত্র' নামে একটা বইয়ের দোকান ছিল। সেখানে আমি আর লীনু অনেক যেতাম। বই কিনি আর না কিনি বই গুলো নাড়াচাড়া করতেই ভালো লাগতো। কয়টা টাকাই বা তখন হাতে আসতো! একটু কিছু জমলেই ছুটতাম বইয়ের দোকানে। সেই তখন নাম জেনেছিলাম সৌরীন সেনের – সাংবাদিক, যিনি পলিটিক্যাল গল্প লিখতেন। আমি সৌরীন সেনের 'আখের স্বাদ নোনতা' বইটি কিনে এনে পড়া শুরু করলাম। পড়তে পড়তে কেমন যেন একটা দারুণ অনুভূতি কাজ করছিল। এত সব নতুন তথ্য, অজানা দেশের অভ্যন্তরীণ সব ব্যপার, পলিটিক্সের এত ঘোর প্যাঁচ সব কিছুই ছিল তখন রীতিমত রোমাঞ্চকর।
বইটিতে ছিল আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ফিদেল কাস্ত্রোর কথা - কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রামের কথ, ‘একদিকে মিলিয়ন ডলার, ক্যাডিলাক, টুইস্ট আর জ্যাজ, - অর্ধউলঙ্গ সুন্দরী নর্তকীর আকর্ষণীয় ফ্লোর শো, ক্যাবারের টেবিলে টেবিলে দলিত দ্রাক্ষার প্রবাহ। অন্য দিকে আসে বিপ্লব…. তাজা তাজা যৌবনের শাণিত স্রোতে রচিত হয় বিপ্লবী কিউবা। সহস্র কন্ঠে ধ্বনিত হয়, - ফিদেল কাস্ত্রোর নাম।’
এখন হয়তো আমি জানি আর্থ সামাজিক অর্থনীতির অনেক ব্যাখা। কিন্তু তখন সেই সময় আমার অনভিজ্ঞ মন, যা পড়েছি তার সবই ছিল আমার কাছে নতুন আর অজানা। তখনই আরও গভীর ভাবে জেনেছিলাম কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রামে ফিদেল কাস্ত্রো আর চে'য়ের অবদান আর তাঁদের মহত্ত্বের কথা। দেশের জন্য আত্মদান আর আত্মত্যাগের সেইসব মহতী উদাহরণ।
আজকাল internet সব মানুষকেই কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। মিত্র অ্যান্ড ঘোষের web siteএ দেখলাম 'আখের স্বাদ নোনতা' বইটি আবার নতুন করে প্রকাশ করেছে এত বছর পর। আর সেটা দেখার পর আমার মনটা বুঝি উড়ে গেল সুদূর অতীতে। ঠিক করলাম বইটি আবার পড়তে হবে। অন্তত ৪৪/৪৫ বছর আগে যে বইটি পড়ে মন এত উদ্বুদ্ধ আর আলোড়িত হয়েছিল আজ আবার পরিণত বয়সে সেটি আর একবার পড়ে দেখতে চাই।
মিত্র এন্ড ঘোষের ভানুদা, ইন্দ্রানী, নূর, এঁরা সবাই আমাদের কাছের মানুষ। কিন্তু তাঁরা থাকেন কলকাতায়। আশীষ দা’ প্রতি বছর সিডনীর বৈশাখী মেলাতে বইয়ের স্টল দেন। আশিষ দা’কে ধরে বসলাম ‘আনতেই হবে বইটি’, আনার ব্যবস্হা হল। সেই জন্য আশিষ’দাকে অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা । খুব খুশী লাগল এত এত বছর পর বইটি আবার হাতে পেয়ে।
এই এতগুলি বছরে পুরো পৃথিবী জুড়ে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। কিউবা’র রাজনীতি আর সমাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আমেরিকার sanction আর বাধানিষেধ দিয়ে বিগত ৫০ বছর ধরে অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে কিউবাকে অন্য সব দেশ থেকে বিছিন্ন রাখবার যে চেষ্টা করা হয়েছিল সেটা কোনো কাজে আসেনি। সেসব বেড়াজাল টপকে কিউবা দিনে দিনে শক্তিশালী ও স্বনির্ভর দেশ আর জাতিতে পরিণত হয়ে উঠেছে। আজ কিউবাতে আবাদি জমির দুই তৃতীয়াংশে আখের চাষ হয়। তামাক, কফি, ফল, শাকসবজি, কর্ন, আলু, চাল প্রভৃতি প্রধান কৃষিপণ্য। বনজ ও খনিজ সম্পদেও কিউবা সমৃদ্ধ।
‘আখের স্বাদ নোনতা’ বইটি কিউবার বিপ্লবী স্বাধীনতার উপর লেখা। পড়েছিলাম ৭০ দশকের প্রথম ভাগে। বইটি পড়বার পর থেকেই মনে মনে অনেক বার ভেবেছি ফিদেল কাস্ত্রো বেঁচে থাকতে থাকতে একবার কিউবা যাব। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য ২০১৬তে না ফেরার দেশে চলে গেছেন ফিদেল কাস্ত্রো। আজও আমার যাওয়া হয়নি কিউবা।
এত বছর পরও দেখলাম বইটি পড়তে ভালো লাগলো। নতুন করে আবার সেই উত্তাল দিনগুলির কথা বারবার মনে পরলো। সময়কে পিছনে ফেলে জীবন এগিয়ে যায়। কাল অতীত হয়। তবু বর্তমানকে ছাড়িয়ে অতীতের পদধ্বনি শুনি আর উতলা জীবন অধীর হয়।