বয়স তখন পাঁচ কী ছয়। বাসায় আলমারির সংখ্যা চার। একেকটার আবার একেকটা নাম। নামের সে কী চমৎকারিত্ব! প্রথম যিনি এসেছিলেন তার নাম 'স্বর্গ দুয়ার', তারপরেরটির নাম 'মুক্তিযুদ্ধ', এরপর 'দেবশিশু', চতূর্থটি 'আলোর কণা'। এসব নামের মানে কী? কোনভাবেই এসব নামের রহস্য উদ্ধার করতে পারছিলাম না। মাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি। প্রতিবারই মা বলেন, 'শোন দুর্গা, এখন বোঝালেও বুঝবি না। আরেকটু বড় হ। তখন সব বুঝিয়ে বলবো। ' আমি বড় হবার অপেক্ষায় থাকি। রোজ আয়নার সামনে দাঁড়াই । পায়ের গোড়ালি উঁচু করে নিজেকে বড় ভাবার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাই।
এই ত্রাহি মধুসূদনে আরেক রহস্য উপস্থিত হয়ে আমাকে উত্তেজনার এভারেস্ট চূড়ায় তুলে দিলো। এক দুপুরে ডাইনিং টেবিলের আলোচনায় শুধু এটুকু বুঝলাম আজ কিছু একটা হতে চলেছে। গাড়ি চালক শাহ আলম কাকাও এই চক্রান্তে জড়িত। সবার চোখেমুখে, বিশেষ করে মায়ের চাপা আনন্দ দেখার মত। ভাতঘুমের আমেজ টুটে গেল বেশ কিছু পায়ের শব্দে আর টুকরো কথার আমেজে। 'এই ডানদিকে কাত কর', 'আস্তে-ধীরে নে ব্যাটা', 'নিচে একটা বস্তা দিয়া ল ', এই তো, আর একটু ঘুরা', - এসব বাক্য কানে এলে ঘুম পালাতে বাধ্য। বাড়িতে কিছু একটা এসেছে আর আমি ঘুমিয়ে থাকবো, তাই কী হয়? এক ছুটে খাট থেকে নেমে বসার ঘরে গেলাম। কাণ্ডকীর্তি দেখে আমার সাইজের চেয়ে আমার মুখের হাঁ এর সাইজ পারলে বড় হয়ে যায়। বিস্ময় আর অভিমান একসাথে। বিস্ময়ের কারণ-বাড়িতে বইয়ের নতুন আরেকটা আলমারি এসেছে আর অভিমানের কারণ-এই ঘটনা আমার দুই বছরের ভাইটাও দেখলো মায়ের কোলে বসে আর আমিই কিনা অন্ধকারে! এ নিয়ে মোট আলমারির সংখ্যা দাঁড়ালো পাঁচ।
বাবা পঞ্চম বইয়ের আলমারিটায় খুব যত্ন করে একটা স্টিকার লাগালেন। স্টিকারটাও বেশ অদ্ভুত। একটা কলমের ডিজাইনে তৈরি। তাতে গায়ে লেখা 'অস্ত্রাগার'। কোন ভাবেই ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো না। আলমারি ভরা বই অথচ বাবা লিখে রেখেছেন অস্ত্রাগার। এ কেমন কথা! ভুল করে লেখেননি তো? নাকি সত্যিই কোন অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন। যে কোন ভাবেই খুঁজে বের করতে হবে আসল রহস্য। দিন গড়িয়ে গড়িয়ে মাসের মাকামে পৌঁছে, মাস হাঁটতে হাঁটতে বছরের বাড়ি। আমি আর বড় হই না। ভাগ্যিস সুনীলের 'কেউ কথা রাখেনি' তখনো জানি না। জানলে সেই ঢঙে আমিও মাকে প্রশ্ন করতাম, 'মা, আমি আর কত বড় হবো ? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায় এই পাঁচ নামের মানে বলে দেবে'। আমি হাঁসফাঁস করি। হাঁসফাঁস করতে করতেই বইয়ের রাজ্যে ডুবে যাই। তবে প্রাপ্তির মধ্যে একটাই। স্বর্গ দুয়ার অব্দি আমার বিচরণের অনুমতি মিলেছে। ফলত সুকুমার রায়, ঠাকুর মশায়, পৃথীরাজ সেন, উপেন্দ্রকিশোর, দক্ষিণারঞ্জন সবার দেখা পেয়ে গেছি। মায়ের কল্যাণে ফেলুদা, শার্লক হোমস এর সাথেও আমার পরিচয় ঘটে গেছে। তো তারা আমায় ফুসলিয়েই যাচ্ছে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে, ঘাড়ের পেছনে চাপাস্বরে, মগজের মগডালে বসে মগজধোলাই করেই যাচ্ছে। এরিক ক্যাস্টনার এর এমিল এন্ড দ্যা ডিটেকটিভস বইটি বাবা জাপান সফরে গিয়ে আমার জন্য কিনেছিলেন। এমিলের মায়ের কষ্টার্জিত অর্থ চুরি হলে এমিল এবং তার কয়েকজন ক্ষুদে গোয়েন্দাবন্ধুর উদ্ধার তৎপরতার দুর্দান্ত বর্ণনা। একদিকে মায়ের প্রতি ভালোবাসা অন্যদিকে তার বুদ্ধিমত্তার মেধাবী উপস্থাপন আমাকে একেবারে এমিলের ভক্ত বানিয়ে দিলো। আহা! এমিলকে পাওয়া গেলে নিশ্চয়ই এতদিনে এই নামগুলোর রহস্যের কিনারা করে ফেলতাম। আলমারি থেকে মা বেছে বেছে বই বের করে দিচ্ছেন আর আমি পড়ে যাচ্ছি। এটাও এক চিন্তা । সব বই পড়ার সুযোগ মিলছে না। সেখানেও একই কথা- এ বই পড়ার সময় হয়নি এখনো দুর্গা। আরেকটু পরে। হায়! এই সময় হয়নি শুনতে শুনতে জীবন থেকে আরো পাঁচ সাতটি বছর কেটে গেল। একদিন সত্যিই রেগে গেলাম মায়ের উপর। কপাল কুণ্ডলা বইটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। পাশেই জেন অস্টিন তার প্রাইড এণ্ড প্রেজুডিস নিয়ে তাকের উপর পা ঝুলিয়ে ডাকছে। নিয়ম ছিলো কোন বই পড়তে গেলে মায়ের কাছে জেনে নিতে হবে৷ আমার পড়ার মত বই হলে সামনে পাতা টেবিলে রাখা রেজিস্ট্রার খাতায় মায়ের সামনে বইয়ের নাম লিখে নিজের নাম লিখতে হবে। কত তারিখে পড়া শুরু করলাম লিখে তারপর পড়া শুরু। আবার শেষ হলে সেই তারিখটা লিখে দিতে হবে। এখানেও টুইস্ট। তারিখটা ইংরেজিতে লেখার আগে বাংলায় লিখতে হতো। এই রুমটাতে পাঁচটা আলমারি ছাড়াও ছিলো ষোলজন বিখ্যাত ব্যক্তির ছবি, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ'র ছবি, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের একটি ও মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের দুটি ছবি। মোটমাট ২৬ টা ছবি। একটা বাংলা ক্যালেন্ডার, টেবিলের চারপাশে মোট ছয়টা চেয়ার। প্রত্যেক চেয়ারের সামনে একটা করে খাতা ও কলম রাখা যেন বই থেকে কোন কিছু টোকার প্রয়োজন হলে তাকে কারো কাছে কাগজ-কলম চাইতে না হয়। টেবিলের ঠিক মাঝখানটায় একটা পিতলের ফুলদানি। রোজ আমাদের বাগানের মালি কাকু এসে ফুলদানিটায় কিছু রঙিন পাতা আর ফুল রেখে যেত। মা ছিলেন এই রুমটার সার্বক্ষণিক দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থাৎ হর্তাকর্তাবিধাতা। বাবা পার্ট টাইম দেখেশুনে রাখতেন। অফিস থেকে ফিরে আমাদের সময় দিতেন। নিয়ম ছিলো ন’টার মধ্যে খাওয়ার পাট চুকানোর। এরপরে বাবাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না অই ঘরটা ছাড়া।
যাই হোক যে গল্পে ছিলাম। আমার হাতে কপাল কুণ্ডলা দেখেই মা বললেন, 'দুর্গা, আরেকটু বড় হতে হবে।
-মা, এই এক কথাই তো শুনি সবসময়। আলমারির নাম জিজ্ঞেস করলে ‘বড় হও’, বই ধরলে আরেকটু বড় হও, ছবির কথা জিজ্ঞেস করলে আরেকটু বড় হও। আমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি।
মা মৃদু হাসলেন। এর মধ্যে বাবা এসে মাকে বললেন, ‘নীলু আর ওকে ধোঁয়াশায় রেখো না। আমায় কোলে টেনে নিয়ে বললেন, ‘আয় মা, আমি তোকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। প্রথম আলমারি ‘স্বর্গ দুয়ার’। এর মানে হল আমি তোর মাকে বিয়ে করার পর এই বইয়ের আলমারিটাই ছিলো আমার টিউশনির টাকায় বানানো প্রথম উপহার যা তোর মাকে আমি দিয়েছিলাম। তোর মাই অবশ্য চেয়েছিলো। শাড়ি-গয়না না, দামী কোন উপহার না সে চেয়েছিলো বুক শেলফ। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর ডাক এলো দেশ স্বাধীন করার। লেখাপড়া বাদ দিয়ে আমি আর তোর বড় মামা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লাম। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে লেখাপড়া শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি পেলাম। নতুন সংসারে অই আলমারিটা ছাড়া আর কিছুই আনিনি। এর বেশ কিছুদিন পর এলো নতুন আরেকটা আলমারি। নাম রাখা হল 'মুক্তিযুদ্ধ'। এরপর আমাদের ঘর আলো করে এলি তুই। তাই তৃতীয় আলমারির নাম রাখা হল 'দেবশিশু', সাড়ে তিন বছর পরে এলো তোর ভাই। এবার চতুর্থ আলমারির নাম হল 'আলোর কণা'। পঞ্চম আলমারিটা এলো আমাদের বিয়ে বার্ষিকীতে। আজ থেকে এখানকার সব বই তুই পড়বি। শিখবি, জানবি, জানাবি। বই আর কলমের চেয়ে বড় অস্ত্র আর কী আছে রে মা? সেজন্যে এই আলমারির নাম রাখা হল 'অস্ত্রাগার'। এই অস্ত্রাগারের মালিক এখন থেকে তুইও। মা আর আমি তোকে ট্রেনিং দিয়েছি। ভাইটা বড় হলে ওকে তুই ট্রেনিং দিবি।
এবার আসি ষোলটা ছবিতে। এই ষোলজন বাংলা ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠকে তো এতদিনে চিনেই ফেলেছিস। আর একটা ছবি আমাদের যুদ্ধের সময়কার। আর একটা ছবি আমাদের জাতির পিতার। যদিও ষোলজনের মধ্যে তাঁর একক ছবি আছে কিন্তু এটা তার পরিবারসহ। এই মোট ছাব্বিশটা ছবি আমাদের ছাব্বিশে মার্চকে স্মরণীয় করে রাখতে। মা রে, লাইব্রেরি তো ঘরে ঘরে থাকতে হবে, পাড়ায় পাড়ায়। যত পড়বি তত নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হবে আর এই ক্ষুদ্র হতে হতে যখন মিলিয়ে যাবি তখনই তোর ভেতরের আলো বিলিয়ে দেবার সময় আসবে। আমি চাই তুই লিখবি। অনেক অনেক লিখবি। তাই এই শেষ আলমারিটায় অনেক অনেক কলম আর খাতা রাখা আছে। এসব তোর জন্য, তোর ভাইয়ের জন্য। আমাদের সবার জন্য। মায়ের উপর রাগ করিস না রে। মা তোকে লেখক হিসেবে তৈরি করার ধাপটা ঠিক রাখার জন্যই কখন কী বই পড়তে হবে তা বলে দিতেন। আজ থেকে তুই স্বাধীন। তোর যা পড়তে ইচ্ছে হয়, পড়বি। না বুঝলে মা কে, আমাকে জিজ্ঞেস করবি। আমি হয়তো অনেক ধনসম্পত্তি রেখে যেতে পারবো না, কিন্তু যা রেখে যাবো তা দিয়ে পথ ও পাথেয় দুটোই মিলবে। রবীন্দ্রনাথ কী বলে গেছেন জানিস?
’হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে তেমনি এক লাইব্রেরির মধ্যে মানব হৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে।...'
হায় ঠাকুর এসব বলে বলে আমার বাবা-মায়ের মাথা কে বলেছিলো খেতে? মা আবার পড়তে শুরু করেন। আমি ঘুমে ঢলে পড়ি। তবু
লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানবহৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যে-দিকে ধাবমান হও, কোথাও বাঁধা পাইবে না। মানুষ আপনার পরিত্রাণ কে এতটুকু জায়গার মধ্যে বাঁধাইয়া রাখিয়াছে।
শঙ্খের মধ্যেই যেমন সমুদ্রের শব্দ শোনা যায়, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে কি হৃদয়ের উত্থান পতনের শব্দ শুনিতেছ। এখানে জীবিত ও মৃত ব্যক্তির হৃদয় পাশাপাশি এক পাড়ায় বাস করিতেছে। বাদ ও প্রতিবাদ এখানে দুই ভাইয়ের মতো একসঙ্গে থাকে, সংশয় ও বিশ্বাস সন্ধান ও আবিষ্কার এখানে দেহে দেহে লয় হইয়া বাস করে। এখানে দীর্ঘপ্রাণ স্বল্পপ্রাণ পরম ধৈর্য ও শান্তির সহিত জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেছে, কেহ কাহাকেও উপেক্ষা করিতেছে না।
কত নদী সমুদ্র পর্বত উলঙ্ঘন করিয়া মানবের কন্ঠ এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে- কত শত বৎসরের প্রান্ত হইতে এই স্বর আসিতেছে। এসো, এখানে এসো, এখানে আলোকের জন্মসংগীত গান হইতেছে...' (লাইব্রেরি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বাবা পড়ে শোনাচ্ছেন আর আমার মনের মধ্যে এক ঝলকে অনেকটা বাতাস ঢুকে পড়ছে। আহা আমি লেখক হবো! আমার স্বপ্ন, বিস্ময় এক সাথে লুটোপুটি খায়, আমার ভালোবাসার জলে অবগাহনের সময় এলো বলে। আমি তো শুধু লিখতেই চেয়েছিলাম। ভালোবাসা জমিয়ে জমিয়ে পাহাড় বানাতে চাই। সবাই অপার আনন্দে সেই পাহাড়ে বসত গড়ুক। বাবাও চাইছেন আমি লেখক হই! বাবা কী করে আমার মনের ইচ্ছেটা বুঝলেন। চিৎকার করে আনন্দে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আলমারিগুলোর দিকে তাকিয়ে গাইতে ইচ্ছে হলো…
‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা ,
ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে
চক্ষে আমার তৃষ্ণা
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন
সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে…’
সুকুমার রায়ের কথাটাও কিন্তু সর্বাংশে সত্য,বাবা বলে চলেন-
“একদিনে কেউ লেখক হয় না। এর জন্য লাগে দীর্ঘ সাধনা আর প্রচুর পরিশ্রম। থাকতে হয় দৃষ্টি এবং দৃষ্টিভঙ্গী। তবে শুধু এতেই চলে না, লেখালেখির জন্যে আরও যেটা লাগে, সেটা হল গৃহিনীপনা আর কাঠামোজ্ঞান – ভাষার ব্যবহার, বাক্য গঠন, ছন্দ নিরূপন, বলবার ভঙ্গী, নাটকীয়তা সৃষ্টি ও বিষয়বস্তুর বিন্যাস – এসব আপনা আপনি আসে না, সচেতনভাবে শিখতে হয়, যদিও দৃষ্টিভঙ্গী শেখানোর নয়, ওটা আসে ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে।‘
অতএব এই সচেতনতা শিখতে প্রয়োজন বই আর বই। আর এই বই সংগ্রহের উপযুক্ত স্থান হচ্ছে লাইব্রেরি। আমি বাবার কথা শুনি আর মনে হয় এতদিন কত কসরত করে বড় হতে চেয়েছি। আর বাবা আজ ম্যাজিশিয়ানের মত এক নিমিষেই আমাকে বড় করে একটা বাগানের মালিক বানিয়ে দিলেন। আসলে লাইব্রেরি শব্দটিই আমার কাছে বাগানের মত। এক বাগানে যেমন হাজারো ফুল আর তাদের যত্নও আলাদা। তেমনি লাইব্রেরি মানেই হাজারো বইয়ের শাখাপ্রশাখা আর তার প্রতিটি শাখায় বিচরণের জন্যে চাই সাধনার নিরবিচ্ছিন্নতা, চর্চার ধৈর্য। তেমনি লেখার জন্য চাই আঙ্গিকের মুন্সিয়ানা, উপস্থাপনের কৌশল, ব্যকরণের প্রায়োগিক দক্ষতা। মনে ও মননে যারা লিখতে ভালোবাসি তারা হয়তো তাদের এই ইচ্ছের জন্যেই এগিয়ে যাই অনেকটা, কিন্তু তারপর? সুপ্ত ইচ্ছে বা মনের জোর দিয়েই লেখালেখির কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া যায় না। দূরদর্শিতা, সচেতনতা আর নিপুণতা দিয়ে সেই ইচ্ছে ও প্রতিভার পরিপূর্ণ পরিস্ফুটনও প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে পড়ার কোন বিকল্প তৈরি হয়নি। আর পড়ার মত ইবাদতের জন্য লাইব্রেরি হচ্ছে জ্ঞানের পবিত্রালয়। আবার মাঝেমাঝে মনে হয় লাইব্রেরি আমাদের সাহিত্য বাগানের মালি বা সেই পথের ল্যাম্পপোস্ট যে যত্ন করে আলো ছড়ায় জীবনদর্পণে। আমরা বাবা-মায়ের কল্যাণে এমন একটি বাগান বা পবিত্রালয় বাড়িতেই পেয়ে গিয়েছিলাম।
খেলতে চাইলেই বাবা বলতেন, লাইব্রেরিতে বসে লেখ না। লেখাও তো একরকম খেলা। শব্দ আর মাত্রার খেলা। আমি হা করে শুনতাম। মৃদু হেসে বলতেন, 'বুঝলি না তো, দুর্গা ?'একার-আকার ঠিক রেখে শব্দ দুটি পালটে দে তো। দেখবি দিব্যি খেলা হয়ে গেছে৷ এবার সেই উলটো শব্দে আকার-একার পালটে দিয়ে দেখ। লেখাটা তখন সোজা খালে পড়ে যাবে। কারণ শব্দ মাত্রা সবই তো উলটে দিয়েছিস। আর শব্দ ঠিক রেখে মাত্রাটা নিয়ে যদি তেমন করে খেলতে পারিস তাহলে কী হবে ভেবেছিস ?
‘কী হবে বাবা?’ উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করতাম। বাবা বলতেন, ‘অই লেখাই লাখে একটা হয়ে যাবে৷
আমি সেই লাখে একটা লেখার সাধনা করছি বাবা। পেলে ভালো, না পেলেও দুঃখ নেই। বাবার সাথে নতুন করে নতুন ভুবনে লেখা লেখা খেলা হবে ফের। লিখতে গেলেই মনে হয়, তুমি যদি থাকতে তবে নিশ্চয়ই এসব লেখা পড়ে জানাতে, তোমার দুর্গা আদৌ শব্দ আর মাত্রা নিয়ে খেলতে শিখলো কিনা...
তোমার সেই পাঁচ আলমারি ভরা সম্পদের সামনে দাঁড়িয়ে আজো ভাবি-
‘আমারে তুমি অশেষ করেছো, এমনি লীলা তব-
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।।‘