ভালোবাসা বই নিয়ে
নাসরীন নঈম। অষ্টম শ্রেণী পার হয়ে কোনো মতে ঢুকে গেলাম জগৎ এবং জীবন সংসারের সীমাহীন রহস্য আর কৌতুহলের ধূম্রজালে জড়ানো বিভূতিভূষণের আম আটির ভেঁপু আর পথের পাঁচালীর অপু দুর্গার প্রকৃতির রাজ্যের ঘুরে বেড়ানো
সেই শৈশব। ফড়িংয়ের মত উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীন জীবন। অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যাতীত সমস্যার অন্তরালে বেড়ে উঠেছিলাম স্বর্ণলতার মত। পড়ার টেবিলে সুদৃশ্য আবরণ থাকতো না বড় একটা। দৈনিক পত্রিকার পুরানো সংখ্যাগুলো আমার মা গুছিয়ে রাখতেন এবং ওগুলোই টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিতেন। ঐ কাগজগুলোর বেশির ভাগই ছিল দৈনিক ইত্তেফাকের দাদাভাইয়ের কচি-কাঁচার আসরের পাতা। পড়তে বসে হারিকেনের ক্ষীণ আলোতে আমি প্রথমেই ছড়া এবং কবিতা গুলো বিড় বিড় করে পড়তাম চিনতাম আফলাতুন, ফয়েজ আহমদ, আহসান হাবীব আর এখলাস উদ্দিন আহমদ। আর ওভাবেই শুরু হলো আমার পড়ার অভ্যাস। পাড়ার মুদি দোকান থেকে ঠোঙ্গায় করে চিনি, মসুর ডাল আর লবণ এনে ঠোঙ্গার লেখাগুলো মন দিয়ে পড়তাম, অসমাপ্ত লেখা গুলোর জন্য মন খারাপও হতো কখনো। মনে পড়ে সবচেয়ে প্রথম যে বইটি হাতে আসে সেটি সতীনাথের ‘ধারাপাত’। বারান্দার মাদুর পাতা আসরে পা লম্বা করে হাঁটুর ওপর যে বইটি নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতাম তার নাম ‘শিশুশিক্ষা’, ‘আদর্শ লিপি’এবং শিশুশিক্ষার সোপান বেয়ে একদিন আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে পাড়ার একজন বীথি আপার বাড়ির কাঁচের আলমারিতে রাখা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চটি বইগুলোর অগভীর ইঁদারায় ডুবে যেতাম। ডাকঘরের অমলের জন্য কষ্ট ছোট্ট বুকে তীরবিদ্ধ পাখির মত তড়পাতো অহর্নিশ। ‘মেজদিদি’ গল্পের হেমাঙ্গিনীকে নিজের মা মনে হতো। কষ্টের জন্য কষ্ট পেতাম সারারাত। ক্লাশ সেভেনে ওঠার পর ‘দেবদাস’হাতে আসলো। পড়াশেষে বালিশে মুখ গুঁজে হু-হু করে কাঁদলাম সারাদুপুর। ফিস্ ফিস্ করে পার্বতীকে পারু পারু করে ডাকলাম। নাহ্। তবু কষ্ট কমেনা। সহপাঠি দু’একজন বললো, ‘রামের সুমতি’ পড় মন ভাল হবে। আবার রামের জন্য দুঃখ বাড়লো। বৌদি নারায়নীকে ভালবাসলাম। নারায়নীর মা দিগম্বরীকে পৃথিবীর সব দজ্জাল মহিলাদের প্রতিভূ হিসেবে চিহ্নিত করে রাখলাম। আজও কোন সংসারে কোন বৌদির মার অবস্থান দেখলে আমার মনে হয় উনি দিগম্বরী হয়ে যাবেন না তো। ‘আজ তুমি থাকো। কাল কিন্তু বাড়ি যেও।’ মায়ের প্রতি নারায়নীর এই উক্তিটি আমার কাছে খুব জম্পেশ মনে হয় আজও। সমাজের সব দিগম্বরীরা যদি একটু অপমানিত হয় নিজের কৃতকর্মের জন্য।
বই নিয়ে লেখাঃ বই পড়ার স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, বইয়ের আলোচনা, প্রবন্ধ এবং বই নিয়ে আরও অনেক কিছু আপনিও পড়ুয়া'য় লিখুন। আমাদের কাছে লেখা পাঠাবার ঠিকানা editor@porua.net
অষ্টম শ্রেণী পার হয়ে কোনো মতে ঢুকে গেলাম জগৎ এবং জীবন সংসারের সীমাহীন রহস্য আর কৌতুহলের ধূম্রজালে জড়ানো বিভূতিভূষণের আম আটির ভেঁপু আর পথের পাঁচালীর অপু দুর্গার প্রকৃতির রাজ্যের ঘুরে বেড়ানোর অপার আনন্দে। অজানা-অদেখা সব ফুল-ফল-বৃক্ষ এবং পাখিদের সাথে হলো চেনা-জানা।
হরিহর রায়ের জীবিকা আর জজমানী সম্পর্কে জানলাম। জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্টকে জয় করতে পেরেছিল বলেই হয়ত অপু দুর্গার মার নাম সর্বজয়া।
‘খিড়কি’ শব্দটি আমি ঐ বইতেই প্রথম পড়ি। বানরের খাদ্য নোনাফল যে দুরন্ত দুর্গা দাঁতের ফাঁকে ফেলে দিয়ে চিবিয়ে খেত- এতে দুর্গার প্রতি বড়ই মমতা হতো। আহারে দুর্গা আমাদের মত লজেন্স, চকোলেট খেতে পায় না। চকবারতো প্রশ্নই উঠেনা। ‘ক্ষারকাঁচা’বিষয়টিও ঐ বই থেকে শিখলাম। ‘সুদর্শন’ যে একটি পোকার দেবতা আর দুর্গা যে ঐ সুদর্শনের কাছে জোড় হাতে একটি ‘বর’ প্রার্থনা করেছিল বলে মনে মনে খুব লজ্জা পেতাম ছিঃ দুর্গাটা কি বেশরম! আজ আমার মনে হয় কিশোর বয়সটাকে লেখক হবার তাগিদে প্রাণিত করেছিল পথের পাঁচালী। এরপর নীহাররঞ্জন গুপ্তের হসপিটাল, মাধবী ভিলা পড়তে পড়তে ক্ষুদে পড়ুয়ায় পরিণত হলাম।
তারপর ক্রমান্বয়ে এলো রবীন্দ্রনাথের গোরা, নৌকাডুবি আর ডাকঘর। অসুস্থ অমলের জন্য শোক-তাপ ভুলবার জন্য হাতে নিলাম সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনম, চাচাকাহিনী। স্কুল ফাইনাল পাশ করার সাথে সাথে নিজেকে ‘গ্রন্থকীট’ হিসেবে আখ্যা পেলাম বন্ধুদের কাছে। ক্লাসিক উপন্যাসগুলোর গভীরে যাওয়ার আনন্দে নাওয়া খাওয়া হতো না প্রায়শই। বঙ্কিমীভাষাটা একটু কষ্ট হতো বুঝতে। শরৎচন্দ্রের মত এক নিঃশ্বাসে পড়া যেতনা তবুও শেষ পড়লাম, বিষবৃক্ষ! দেবী চৌধুরানী। কপালকুন্তলার সেই বিখ্যাত সংলাপ ‘‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’’ একজন নবকুমারের মত সহজ, সরল পরোপকারী মানুষের খোঁজে বিরতিহীন পড়তে শুরু করলাম বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’ প্রতিভাবসুর ‘‘জীবনের জলছবি” কালকুটের ‘কোথায় পাব তারে’। অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘অচিন রাগিনী’। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিজেকে মনে হতো একটু স্বতন্ত্র গোত্রের অসহায় পক্ষীকূল। কারণ অন্য মেয়েদের মত শাড়ী গহনায় আমার আলমারী ভরা থাকতো না। বইয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুরে বেড়াতাম বাংলা একাডেমি, পাবলিক লাইব্রেরি কিংবা কোন বন্ধুর বাড়ির পৃথক কামরায় গড়ে তোলা ছোট্ট লাইব্রেরিতে। ভুলে যেতাম ঘরে আমার দুইমাসের শিশু কন্যা হাত পা নেড়ে বিছানায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। ভুলে যেতাম শিক্ষকদের নজর কাড়তে হবে, ভাল ফলাফল করে পাশ করতে হবে।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘লালসালু’ এবং মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’পড়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে। লালসালুর মজিদ আর পদ্মানদীর মাঝির ‘কুবের’ আজও আমার চেতনায় একটি শক্তিমান সংযোজন। একজন ভন্ড আর একজন দারুণ প্রতিবাদী কর্মঠ। বাঙালী সমাজ আর সনাতন বিশ্বাসের মর্মমূলে ঐ দু’জন প্রভাবশালীর কুঠারাঘাত আমরা কি আজও সহ্য করছি না? দ্বিজাতিত্ত্বের ফর্মুলার বাইরে গিয়ে প্রকৃত বাঙালী হয়ে ওঠাটাই এখন আমাদের একান্ত প্রয়োজন। এই প্রয়োজনের তাগিদেই কুড়ি বছর বয়সের পর থেকেই কেন বুঝি না কবিতার প্রতি প্রবল ভাবে ঝুঁকে পড়ি। জীবনানন্দ দাশ এখনো আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ তো সীমার মাঝে অসীমের মধ্যেই শক্তিমান পুরুষ হিসেবে অমরত্ব লাভ করেছেন। বোদলেয়ার, খৈয়াম, বেনজামিন মলয়েস, সিলভিয়া প্লাথ, এজরা পাউন্ড, লোরকা আর হাইনের কবিতায় মগ্ন হয়ে আছি।
আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’ শামসুর রাহমানের ‘রৌদ্রকরোটিতে’ এখনো বিভোর হয়ে পড়তে থাকি।
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্ত সব পার হয়েও মনের সিন্দুকে জমে থাকে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’।
অনুবাদের কল্যাণে পড়েছি জন ফাউল্সের ‘দি কালেক্টর’, ওয়্যর এ্যান্ড পিস’, ম্যাকবেথ, গোর্কির ‘মা’, ইবসনের ‘ডলস হাইস’, হোমারের ‘ইলয়ড’, টলস্টয়ের ‘আন্না কারেনিনা’। আন্নার জীবনের ট্রাজেডি আসলে একজন বুর্জোয়া স্ত্রীর ট্রাজেডি। ইবসেনের নাটক ‘পুতুলের সংসার’ এর নায়িকা ‘নোরার’ গৃহত্যাগ থেকে বুঝলাম পুঁজিবাদকে অক্ষুণ্ন রেখে ব্যক্তি জীবনে কোন চরিতার্থতা নেই।
রাতে শোবার আগে অবশ্যই কিছু পড়তে হয়- হয় দোয়া দরূদ। নয়তো কোন আধুনিক কবিতার বই। পড়ার রুচি বয়সের সাথে সাথে একটু বদলে যায়। প্রবোধ কুমার সান্ন্যালের ‘দেবত্মা হিমালয়’ পড়তে ভাল লাগে। শাহনামা পড়ছি আবার ভুলেও যাচ্ছি। মৈত্রেয় দেবীর ‘ন হন্যেতে’ নিয়ে বসি আবার। মির্চার ওপর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়। বানীবসুর মৈত্রেয় জাতক হাতে নেই। সময় লাগে পড়তে। সবকিছু মিলিয়ে বইটাকে জীবনের একটি অনুষঙ্গ মনে হয়। মন খারাপ হয়ে বইয়ের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে অপ্রীতিকর ব্যাপার গুলো ভুলে থাকা যায়। পুরনো ‘দেশ’ পত্রিকা ঘেঁটে ঘেঁটে রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলো পড়ছি ইদানিং। ত্রিশের কবিদের সাথে তাঁর চিঠির আদান-প্রদান এবং অন্যান্য বিশেষ ব্যক্তিদের সাথে তাঁর পত্রালাপ পড়ে মুগ্ধ হচ্ছি। এই মুগ্ধতাই যেন আমার জীবনে অনিঃমেষ হয়ে উঠে এই কামনায় নিমগ্ন থাকি।
আমার বাড়িতে একবার ডাকাতি হয়েছে। সোনাদানা এবং টাকা কড়ি সবই লোপাট হয়ে গেছে বিশ বছর আগে। আমার সেজন্যে কোন কষ্ট নেই- কষ্ট কেবল নিজ বাড়িতে একটি বড় কক্ষে মনের মত একটি লাইব্রেরি বানাতে পারছি না। শৈশব থেকে সঞ্চিত যত বই সব একসাথে রাখতে পারছি না। বইয়ের পাহাড়ের ঢালে বসে লিখতে পারছি না। এটাই বড় কষ্টের। আমার সংগ্রহে যত বই আছে সেগুলো ক্রমানুযায়ী সাজাতে পারছি না। এখনো অনেক বই পড়া হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি চলে গেলে আমার প্রিয় বইগুলো এরা কী করবে। কেজি দরে বেঁচে দেবে?
এখনকার গ্রন্থবর্ষ এবং গ্রন্থাগার বর্ষ বিভিন্ন শিরোনামে শিশু কিশোরদের বই পড়ায় আগ্রহী করে তোলার জন্য পাবলিক লাইব্রেরি এবং অনুদিত বই পড়ার জন্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া অভিযানটি খুবই চমকপ্রদ। আমাদের শিশুকালে এত আয়োজন বা সচেতনতা ছিল না। তবে প্রৈতী ছিল প্রখর। নিজের ভুবনে আনন্দ সৃষ্টি করার জন্য বই এবং পাঠাগার আমার কাছে প্রধানতম বিবেচ্য। আকাশ সংস্কৃতি আমাকে এতটা টানে না, যতটা টানে বই।
প্রিয় পাঠক, লেখক এবং বিদগ্ধজন আপনারা বইতে নিমগ্ন হোন, আত্মার উন্নতি হবে। একলা জীবন কিংবা অবসর জীবনে বই আমাদের পরম বন্ধু। ভালোবাসা ও ভাল থাকার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে বই পড়া।
সমাজের এই আরাজকতা অস্থিরতা খুন-গুম, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা যখন মাথায় ঢোকে না, তখন একটি বই হাতে চুপচাপ বসে থাকা অনেক বেশি আরামের। অনেক বেশি শান্তির।