ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার নেশা। এখনও বিন্দুমাত্র কমে নি সে আগ্রহ। প্রতিদিন এখনও অনেক সময় ব্যয় হয় বইয়ের পেছনে। এই দুনিয়ার জীবনে যে-কয়েকটি জিনিস আমার আনন্দের উৎস তার অন্যতম হল বই। গ্রামের বাড়িতে ছিল বাঁশের তৈরি নকশা করা চমৎকার ছোট বইয়ের সেলফ। যৌথ পরিবারে মানুষ ছিলাম অনেক, কিন্তু পরিবারটিতে বইয়ের সেলফ আর কাউকে মুগ্ধ করতে পারে নি। কি এক অব্যাখ্যেও কারণে সেলফটির প্রতি আকৃষ্ট হই আমি, সেখানে খুঁজতাম কাগজের মণিমুক্তা। আমার সাথে সম্পর্ক থাকার জন্য মৌসুমি পাঠক হয়েছে অনেকে কিন্তু জীবনব্যাপী পাঠক হতে পারে নি কেউই। কর্মজীবনে প্রবেশের পর, সেই পাঠকেরা, সংসারের চাহিদার শিরা-উপশিরার বাঁধনে আটকা পড়ে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু কি এক রহস্যে পাঠক রয়ে গেলাম আজও -- পাঠই এক বড় আনন্দ। অনেক সময় ভেবেছি বই নিয়ে এক কেতাবই লিখে ফেলব। সেটা আপাতত সম্ভব না হলেও আগ্রহীদের শোনাব বই নিয়ে কয়েকটি স্মরণীয় ঘটনা।
২.
হঠাৎ করে আগ্রহী হয়ে উঠি আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে। তখনই মনোযোগ আকর্ষণ করে দিনাজপুরের চেহেলগাজি। চেহেলগাজির ইতিহাসের উপর বই খুঁজতে শুরু করি। জানতে পারলাম মেহরাব আলীর (১৯২৫-২০০৯) কথা, তিনি বই লিখেছেন চেহেলগাজি নিয়ে। সৌভাগ্যক্রমে কিছুদিন পরে একটি ভ্রমণে দিনাজপুর যাই, চেহেলগাজি সমাধি নিজের চোখে দেখি। খুঁজে বের করলাম মেহবার আলীর হদিস। ছোট শহর দিনাজপুরের বাংলাদেশ অংশে তিনি খুবই পরিচিত কিন্তু জানতাম না যে তিনি আর ইহলোকে নেই। ব্যথিত মনে বইয়ের খোঁজে তাঁর বাড়ি গেলাম। ভাগ্য ভালো, ঢোকার পথেই দহলিজে মেহরাব আলীর ছেলের সাথে দেখা। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর বইটির কথা জানতে চাইলাম। তিনি জানালেন, একটি মাত্র কপি আছে তাদের সংগ্রহে। দুষ্প্রাপ্য বইটি ফটোকপি করার পর আবার ফেরত দেওয়ার শর্তে ধার দিলেন। বইটি নিয়ে দোকানের খোঁজে বেরিয়ে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখতে লাগলাম। কতদিন ধরে খুঁজছি! না পেয়ে বেদনায় কাতর হয়েছি কতবার। বহু প্রতিক্ষিত সেই বইটি এখন হাতে -- মহামূল্যবান সম্পদ পাওয়ার অনুভূতি মনে। ফটোকপি হলে বইটি ফেরত দিয়ে আসি। দুর্লভ বইটির প্রতিলিপিরও মালিক হতে পেরে অপার্থিব আনন্দে ভরে যায় মন। প্রয়োজনীয় বই পাওয়ার আনন্দের সাথে বই-প্রেমিকের আর কোনোকিছু পাওয়ার তুলনা হয় না।
৩.
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের (১৯০১-১৯৬০) সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যপত্র “পরিচয়”। সেই “পরিচয়” পত্রিকাকে কেন্দ্র করে হত আড্ডা। ওই আড্ডায় উপস্থিত থাকতেন তখনকার বড় বড় লেখক, সেই সময়ের শিক্ষিত মানুষের কেবলা ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজ ফেরত অনেকে। একবার সেই আড্ডা সম্পর্কে জানবার খুব আগ্রহ তৈরি হলো। ওই আড্ডার উপর বই লেখেন শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ -- নাম “পরিচয়ের আড্ডা”। শুরু করলাম বইটি খোঁজা কিন্তু পরিচিত কারো কাছে পাওয়া গেল না। তখন বন্ধুদের কেউ কেউ হায়াৎ মামুদ স্যারের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেন। আগেই কানে পৌঁছেছিল হায়াৎ স্যারের ঈর্ষণীয় ব্যক্তিগত সংগ্রহের খবর। একদিন সত্যি সত্যি গিয়ে হাজির হলাম বাসায়। বইটির কথা বলতেই সুখবর দিলেন। অমনি আনন্দে ভরে গেল মন। আহ্! কতদিন ধরে খুঁজছি বইটি! স্যার সোজা নিয়ে গেলেন তাঁর বাসার দোতলা ঘরটিতে। ছোট ঘরটি রীতিমত এক বইয়ের জাদুঘর। অল্পক্ষণের মধ্যে বইটি খুঁজে বের করলেন তিনি। বইটি হাতে পাওয়া নিয়ে স্যারের সাথে এক সমঝোতা হলো। বাসার কাজের লোকদের একজন ফটোকপি করে রাখবেন, পরে গিয়ে আমি নিয়ে আসব। পরের দিন বইটি হাতে পেয়ে অমূল্য সম্পদ হাতে পাওয়ার অনুভূতি হলো। স্যার সেদিন বাসায় ছিলেন না, আমি বইটি নিয়ে এসে গেন্ডারিয়াতেই এক চায়ের দোকানে বসলাম। প্যাকেট খুলে বইটি হাতে নিলাম, গরম চায়ে চুমুকের পাশাপাশি চলল প্রিয় বইতে চোখ রাখা। বইটিতে চোখ বুলাতে গিয়েই বুঝতে পারলাম স্যার ফটোকপি করার আগে কাজের লোকটিকে সব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। প্রথম প্রচ্ছদ শেষ প্রচ্ছদ কোনোকিছুই বাকি রাখা হয় নি অনুলিপি করতে। একটা বই মানে তো প্রচ্ছদ, “মলাটি” (ফ্লাপের বাংলা করেছি “মলাটি”) ও পুস্তানি সহ সবকিছু। সুরুৎ সুরুৎ! চায়ে চুমুক দিচ্ছি আর চোখ-মস্তিষ্ক কাজ করে যাচ্ছে বইটির ওপর। ঔপনিবেশিক শক্তিকে তাড়ানোর পর সিমন বলিভারের (১৭৮৩-১৮৩০) অনুভূতি কেমন হতো জানি না, তবে একটি দুর্লভ বই পাওয়ার পর আমার অনুভূতিটির নাম দেই: ‘রাজ্য জয়ের অনুভূতি।’
৪.
শাহেদ সোহরাওয়ার্দিকে (১৮৯০-১৯৬৫) এখনকার প্রজন্ম আর চেনে না। তিনি ছিলেন বিশ্বের একজন বড় শিল্পতাত্ত্বিক। প্যারিসের ইউনেস্কো ভবনের শিল্পসজ্জায় পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩), হার্বাট রিড (১৮৯৩-১৯৬৮) প্রমুখ ব্যক্তিদের সাথে কাজ করেছিলেন শাহেদ সোহরাওয়ার্দি। এই শিল্পতাত্ত্বিকের একটি বইয়ের পুনর্মুদ্রণ হয় তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পর, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় মুদ্রালয় হতে, নাম “দি আর্ট হিস্ট্রি আভ দ্য মুসলমানস ইন স্পেন” (২০০৫)। বইটি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় তন্নতন্ন করে খুঁজেছি -- কিন্তু পাই নি। ইউপিএলে নেই, এনে দিতে বলি কিন্তু কাজ হল না, আশা ছাড়ি নি, বইটি সংগ্রহ করতে হবেই। অবশেষে খোঁজ পাই বইটি আছে কবি কায়সার হক স্যারের কাছে। স্যার ইংরেজিতে কবিতা লেখেন, তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি থাকলেও বাংলাদেশের মানুষ খুব একটা চেনে না। জানা গেল অবসরে গিয়ে তিনি তখন যুক্ত ঢাকার ধানমন্ডিতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে। সেখানে গিয়ে সাথে দেখা করি, এক সময় বইটির প্রসঙ্গ তুললাম। জানলাম বইটি আছে। কপিরাইটের বাঁধা ডিঙিয়ে সঙ্কোচের সাথে বইটির কথা বলতেই তিনি রাজি হলেন। এক সপ্তাহ পরে ফোন দিয়ে এসে বইটি নিয়ে যেতে বললেন। নির্দিষ্ট দিন ফোন করে গিয়ে বইটি নিয়ে সোজা চলে যাই নীলক্ষেত। বইটি পেতে যাচ্ছি জেনে কেউ কেউ তাদের জন্যও ফটোকপি করতে বলেন। সম্পদের পেছনে লেগে থাকলে সম্পদ অর্জন করা যায়!
৫.
তখন স্নাতক সম্মান শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি। স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হতে হবে, টাকা দরকার। এ-জন্য একদিন রওয়ানা হলাম বাড়িতে। যাতায়াত খরচ কমানোর জন্য সোজা চলে এলাম আরিচায়। সেখান থেকে নৌকা করে যমুনা পাড়ি দিয়ে নগরবাড়ি, এরপর বাস ধরে নিজের থানা শহর। নৌকাতে চড়ে বসলাম, হাতে একটি বই, কামাল উদ্দিন হোসেনের (১৯২৩-২০১৩) “রবীন্দ্রনাথ ও মোগল সংস্কৃতি” (১৯৯৮)। খুবই বিখ্যাত বই, আনন্দ পুরস্কার জেতা। নৌকা ছাড়লে চারপাশের নদীর দৃশ্য দেখি আর বইয়ে নজর বুলাই। এক সময় বইয়েই আকর্ষণে সবকিছু ভুলে গভীর মগ্নতায় আচ্ছন্ন হই। হঠাৎ দোয়া-কালামের শব্দে বাস্তবতায় ফিরে আসি। দেখি মাঝ নদীতে এসে পড়েছি, কিছু দূরেই নদীর উপর দিয়ে গেছে বিদ্যুৎ লাইনের টাওয়ার। তখনই মহাবিপদের মধ্যে আবিষ্কার করি নিজেকে। এখানে দুই মানুষ সমান উঁচু ঢেউ। আমাদের নৌকা একবার অনেক উঁচুতে উঠছে আবার গিয়ে থপাশ করে পড়ছে বহু নিচে। সামান্য উল্টালেই সলিল সমাধি ঘটবে, তাই দরদের সাথে দোয়া পড়ছে সবাই। বুঝতে পারলাম জীবন-মৃত্যুর পুলসিরাতের উপর আছি। বিশ্বাস করুন পাঠক, ওই সময় আমার হাতের বইটির কথা মনে পড়ল। বইটি ধ্বংস হয়ে যাবে ভেবে আফসোস হলো! বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের বই এটি। জীবনঘাতী ওই মুর্হূতেও বইটির নষ্ট হওয়ার চিন্তা কিভাবে করতে পারলাম! পরে এটা নিয়ে ভেবে বুঝতে পেরেছি, সত্যি সত্যি বইকে ভালোবাসি। না-হলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে একটি কাগজের বইয়ের চিন্তা কিভাবে মাথায় এল!
বই নিয়ে এমন মজার স্মৃতি আরও আছে। লেখার শব্দ সংখ্যা নির্ধারিত থাকায় এখানেই থামতে হচ্ছে। সময়-সুযোগ মতো সেগুলো লেখা যাবে অন্য কোনো দিন।