পড়ুয়া

Share this post

বই পড়ার আনন্দ

www.porua.net

Discover more from পড়ুয়া

বই নিয়ে পাঠকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো প্রকাশের তেমন সুযোগ থাকে না। পাঠকের বলা না হয়ে ওঠা সেইসব কথাগুলো প্রকাশের ভাবনা থেকে আমরা শুরু করছি পাঠকের জন্য "পড়ুয়া"।
Over 2,000 subscribers
Continue reading
Sign in

বই পড়ার আনন্দ

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

Aug 16, 2023
Share this post

বই পড়ার আনন্দ

www.porua.net
Share
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

ছুটির ঘণ্টা বাজল। কাল থেকে স্কুল বন্ধ, গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেল। স্কুল থেকে বেরােতে বেরােতে কবিরকে বললাম, 'ছুটিটা কি এখানেই কাটাবি?” 

‘কোথায় যাব? কেন, তুই এখানে থাকবি না?” 

না। মামাবাড়ি যাচ্ছি।' বলতে বলতে খুশিতে আমি একেবারে আত্মহারা। বললাম, “পরশু সকালবেলা ট্রেন। তুই কখনাে ট্রেনে চড়েছিস?' 

কবির সগর্বে বলল, ‘তিন বার।’ 

‘আমি এখনও ট্রেনে উঠি নি। কিন্তু পরশুই তাে উঠব, তাই আর মন খারাপ করলাম না। কবিরের সঙ্গে একটু গল্প করে বাড়ি ফিরতে পাঁচটা বেজে গেল। ঘরে ঢুকে দেখি মার সঙ্গে বসে গল্প করছেন মামা আর মামী। ওদের দেখে আমি অবাক। একটু দমেও গেলাম বৈ কি। ওঁরাই চলে এসেছেন, তা হলে আর আমার মামাবাড়ি যাওয়া হয় কি করে? কাছে গিয়ে সালাম করে বললাম, তােমরা কখন এসেছ মামা?' 

আমার মাথায় হাত রেখে মামী হাসলেন, তােদর এবার যাওয়া হল না, টোকন। একটা জরুরি কাজে আমরাই এখানে চলে এলাম।' 

নিজের ঘরে আসতে আসতে আমার চোখে পানি এসে গেল। এর আগে মামাবাড়ি গিয়েছি বাসে, এই প্রথম ট্রেনে যাওয়া হচ্ছে, ট্রেনে যাওয়ার স্বপ্ন আমার কতদিনের। সবাইকে বলেছি এবার মামাবাড়ির আশে-পাশে বনেবাদাড়ে ইচ্ছামতাে ঘুরে বেড়াব। নাঃ। কিছুই হল না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাতে ভালাে করে ঘুমও হল না, ছােটোচাচার পাশে শুয়ে ছটফট করে কাটালাম। 

পরের দিন সকালবেলা মুখ গােমড়া করে বসে রইলাম। দুপুরে ছােটোচাচা নতুন একটা বই আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘পড়ে দেখাে। 

বইটা দেখতে ভারি সুন্দর। মলাটে ঝােপঝাড়ের ভেতর দুটি ছেলেমেয়ের ছবি আঁকা। ভেতরে খুলতেই কি সুন্দর গন্ধ। নাড়াচাড়া করতে করতে কখন যে পড়তে শুরু করেছি নিজেও জানি না। 

অপু নামের একটি ছেলে তার বাবার সঙ্গে গ্রামের বাইরে মাঠে নীলকণ্ঠ পাখি দেখতে যাচ্ছে। ঝােপঝাড়ে ঘেরা মাটির সরু পথ। ভাঁটফুল আর বৈঁচির ঝােপে লাফিয়ে পালায় খরগােশ। ছবির বইতে অপু বড় বড় কানের খরগােশের ছবি দেখেছে। ঘাসের ভেতর জ্যান্ত খরগােশের দেখা পেয়ে সে অবাক হয়ে গেল। নদীর ধারে বাবলা গাছের আড়ালে ভাঙা ইটের পাঁজা। অপুর বাবা বললেন, এখানে ইংরেজদের কুঠিবাড়ি ছিল। কাছেই কুলগাছের নিচু ডালে কুল পেকে লাল হয়ে রয়েছে। বাবলার ডালে বসে দোল খাচ্ছে নীলকণ্ঠ পাখি। 

পড়তে পড়তে আমিও যেন নীলকণ্ঠ পাখি দেখতে লাগলাম। তারপর বইতে কাশবনের ভেতর দিয়ে বােনের সঙ্গে অপু একদিন গেল রেলগাড়ি দেখতে, আমার মনে হল আমিই যেন আমার বােন নাজনীনের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছি। পড়ি আর অবাক হই। আমার মামাবাড়ির গ্রাম হুবহু এইরকম। বইয়ের মধ্যে দিয়ে সেই গ্রামটিকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। যেসব জায়গা দেখেছি একটু দূর থেকে, বইটা পড়তে পড়তে যেন সেই সব জায়গার ভেতর দিয়ে চলতে শুরু করলাম। 

‘আম-আঁটির ভেঁপু’ পড়া শেষ হলে কেবলি মনে হতে লাগল, আহা, গল্পটার আর একটু যদি থাকত। উঠতে বসতে শুধু বইটার কথাই মনে হয়, অপু, দুর্গা, ওদের বাবা মা সবাই যেন খুব চেনা মানুষ হয়ে গেল। ওদের কথা ভাবি, ভাবতে ভাবতে ফের প্রথম থেকে পড়তে শুরু করি। 

ছােটোচাচা আড়চোখে দেখেন, কিছু বলেন না। তিন দিন পর তিনি নিয়ে এলেন আর একটা বই। এই বইটার নাম ক্ষীরের পুতুল। এর মলাটও ভারি সুন্দর। লেখকের নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটা আবার অন্য ধরনের গল্প। এখানে রাজা রানী আছে, রাজবাড়ির কথা আছে। কিন্তু, দুয়ােরানীর দুঃখের কথা পড়তে পড়তে আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আবার গল্পে একটা বদর আছে, তাকে মনে হয় খুব চালাক আর ভালাে একটা মানুষ। তারপর তারই চালাকিতে ক্ষীরের পুতুল কি করে সত্যিকার ছেলে হয়ে গেল তাই পড়ে কি যে ভালাে লাগে। সেই অন্যরকম ঘটনাও আমি যেন চোখের সামনে ঘটতে দেখি। এই বই একবার শুরু করে আর ছাড়তে পারি না। বিকালবেলা খেলার বন্ধুরা এসে ফিরে গেল। বই শেষ করে উঠে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে কখন। 

রাত্রে ছােটোচাচার সঙ্গে শুয়ে বললাম, “ছােটোচাচা, আর একটা বই দাও না। চাচা বললেন, অত গল্পের বই পড়ে না। হােমটাস্কের অঙ্ক করতে হবে না? ‘অঙ্ক করলে বই দেবে তাে?' চাচা বললেন, আগে কর তাে। দেখি কটা অঙ্ক কাল সারাদিনে করতে পার। 

সত্যি কথা বলি, গল্পের বই পাওয়ার লােভেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অনেকগুলাে অঙ্ক করলাম। বিকালে আম্মা বললেন, সন্ধ্যাবেলা বাংলা পড়ে আমার কাছে পড়া দিও। ভালাে করে পড়লে আজ আমি একটা বই দেব।' 

সন্ধ্যা হতে না হতে বাংলা বই খুলে বসলাম, বই থেকে আম্মা পড়া ধরলে ঠিক ঠিক জবাবও দিলাম। আলমারি থেকে আম্মা খুঁজে বের করলেন একটা পুরনাে বই, এটা নাকি তার ছেলেবেলায় পড়া। মলাটটার মলিন চেহারা, ভেতরের পাতাগুলােও একটু লালচে হয়ে এসেছে। অত উৎসাহ পেলাম না। কিন্তু বই পড়ার নেশা আমায় পেয়ে বসেছে। রাতের খাওয়া সেরেই পড়তে শুরু করলাম। এখানে রাজপুত্র কি সাহসী! কোন দেশের বন্দি রাজকন্যাকে দৈত্যের হাত থেকে উদ্ধার করতে নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে সে ছুটে চলেছে কোথায় কোথায়। মশারির ভেতর বসে রূপকথার বই পড়ি আর ভয় ভয় করে। মস্ত এক দৈত্য, তার লম্বা দুটো শিং, আঙুলের নখ সব কোদালের মতাে বিরাট বিরাট। রাজকুমারীকে সে বন্দি করে রেখেছে বনের ভেতর রাজপুরীর ছােট একটি ঘরে ! রাজকুমার তার খবর পায় ঐ বনের একটা গাছের নিচে বসে। গাছের ডালে বসে গল্প করছিল বেঙ্গমা আর বেঙ্গমী। তাদের গল্প থেকেই জানতে পেরে রাজকুমার ঘােড়া ছুটিয়ে দিল দৈত্যপুরীর দিকে। দৈত্য ঘােরাফেরা করছিল তার বাড়ির আশেপাশে। রাজকুমারের গন্ধ পেয়ে সে মার মার করে ছুটে এল, বলল, হাউ মাউ খাউ, মানুষের গন্ধ পাউ। 

পড়ি আর আমার গায়ে কাঁটা দেয়। এই বুঝি দৈত্য এল রে। এসে সে দুজনকেই মেরে ফেলবে। কিন্তু সাহসী রাজকুমার বুদ্ধি করে ঝাপ দেয় দৈত্যপুরীর পুকুরে। সেখানে পানির অনেক নিচে একটা বাক্স আছে। বাক্সের ভেতর সােনার কৌটা। সেই কৌটায় লুকানাে রয়েছে দৈত্যের প্রাণ-ভ্রমরা। ভ্রমরটি মেরে ফেললেই দৈত্য মারা যাবে। পড়তে পড়তে আমার বুক কাঁপে, রাজকুমার তাকে মারতে পারবে তাে? 

মামাবাড়িতে যেতে না পারার দুঃখ আমার আর এতটুকু রইল না। বই পড়ে পড়ে মন খুশিতে ভরে উঠল। বড়ােআপা খুব কবিতা পড়েন। তার কাছ থেকে নিয়ে পড়ে ফেললাম কাজী নজরুল ইসলামের ছােটোদের কবিতার বই। ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতাটা এত ভালাে লাগল যে বারবার পড়ে একেবারে মুখস্থ করে ফেললাম। রবীন্দ্রনাথের ছড়ার ছবির অনেকগুলি কবিতাই সবটা বুঝতে পারি নি, কিন্তু তাতে কি? পড়তে তাে ভালাে লাগে। আম্মা বলেন, বড় হলে বুঝব। আবােল তাবােল’-এর কবিতা কিন্তু ভারি মজার। পড়তে গেলেই কেবল হাসি পায়। 

আব্বা পর্যন্ত আমার বই পড়ার এই ঝোঁক লক্ষ করেছেন। একদিন আমার জন্যে এনে দিলেন নতুন দুটো বই। সাগরতলের জগৎ’ আর ‘আকাশের রহস্য। প্রথম বইটা পড়তে গেলে একটু হোঁচট খাই। এখানে তাে ঠিক আগের বইগুলাের মতাে কোনাে গল্প নেই। কিন্তু কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়তেই সাগরতলের জগৎ আমাকে দারুণভাবে টানতে লাগল। পানির নিচে যে এতসব বিচিত্র প্রাণীর বাস তা আগে কখনাে কল্পনাও করি নি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী যে নীল তিমি আর সে যে ডাঙায় না থেকে পানিতেই থাকে তা পড়ে আমি অবাক হয়ে যাই। হাঙর আর কত অজস্র রকমের মাছ, ঝিনুক আর শামুক আর কত সব প্রাণীর কথা জানতে পাই। মনে হয় আমাদের এই ডাঙার পৃথিবীর মতােই আর একটা পৃথিবী পানির নিচে বিরাজ করে। সেখানেও প্রাণীরা আমাদের মতােই জন্ম নেয়, খায় দায়, বড় হয়। বেঁচে থাকার জন্য তাদেরও কম খাটতে হয় না। আবার ডাঙার মতােই তাদের জগতেও গাছপালা আছে, আমাদের পরিচিত গাছপালার সঙ্গে তাদের মিলও রয়েছে অনেক। 

বই নিয়ে পাঠকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো প্রকাশের তেমন সুযোগ থাকে না। পাঠকের বলা না হয়ে ওঠা সেইসব কথাগুলো প্রকাশের ভাবনা থেকে আমরা শুরু করছি পাঠকের জন্য "পড়ুয়া"। ইমেলে যুক্ত থেকে আমাদের সাথে থাকার অনুরোধ রইলো।

এই বই শেষ করেই হাতে নিই মহাকাশের রহস্য। যে আকাশ রোজ রোজ দেখি তাতে যে এত রহস্য, সেখানে যে আরাে বহু হাজার জগতের অস্তিত্ব এসব কে জানত? রাতের বেলা আকাশ ভরা এত তারা দেখি, এই বই পড়ে জানতে পারি যে তাদের সংখ্যা কোটির ওপরে। এদের মধ্যে আছে নক্ষত্র আবার এদের মধ্যেই আছে আমাদের এই পৃথিবীর মতােই কতসব গ্রহ। পড়তে পড়তে ভাবি ঐসব গ্রহের কোনাে কোনােটিতে হয়তাে আমাদের মতাে প্রাণীও বাস করে। তারা দেখতে কেমন? তারা কি আমাদের মতােই ভাবনা চিন্তা করতে পারে? তারাদের কত সব নাম। সপ্তর্ষিমণ্ডল, কৃত্তিকা, বৃশ্চিক, কালপুরুষ। মানুষ তাে চাঁদে গিয়ে ঘুরে এসেছে বিশ বছর আগে। পড়েছি, মানুষের পাঠানো নভােযান অন্যান্য গ্রহের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। মানুষ কবে যেতে পারবে? সূর্যকে ঘিরে এই যে আমাদের সৌরজগৎ, একেও তাে মানুষ একদিন অতিক্রম করে যাবেই। আব্বার কাছে আমি আবার বই চাই, মহাকাশের আরাে কথা জানবার জন্যে খালি ছটফট করি। আব্বা বলেন, এখন নয়। আর একটু বড় হও। ‘মহাকাশের ঠিকানা' নামে একটা বই আছে। তােমার সামনের জন্মদিনে দেব। আমার জন্মদিন তাে গেল মােটে তিন মাস আগে। সামনের বছরের জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করি।

Share this post

বই পড়ার আনন্দ

www.porua.net
Share
Previous
Next
Comments
Top
New
Community

No posts

Ready for more?

© 2023 Riton Khan
Privacy ∙ Terms ∙ Collection notice
Start WritingGet the app
Substack is the home for great writing