আমরা চার ভাই বোন। ভাইবোনদের সারিতে আমার অবস্থান তৃতীয়। চার ভাইবোনই ছোটবেলা থেকে বাড়িতে প্রচুর বই পড়তাম। নিজে খুব বই পোকা না হলেও, আমার বই পড়ার অভ্যাসটি আসলে এসেছে আমার বড়োভাই এবং বড়োবোনের কারণে। কারণ তারা দুজনেই ছিল সাংঘাতিক পড়ুয়া মানুষ। আমার ভাই পড়ত সেবা প্রকাশনীর ওয়েস্টার্ন সিরিজের বই, মাসুদ রানা, অনুবাদের বই। আর আমার বোন পড়ত বাংলা ক্লাসিক বই যেমন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ও প্রমুখ। সেই সময় আমি স্কুলগামী বালিকা পাঠক হিসেবে বইমেলায় গিয়ে অথবা এলাকার বইয়ের দোকান থেকে সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দার বইগুলো কিনতাম। এলাকায় আমাদের সমবয়সী কয়েকজন বন্ধুর একটা পাঠক চক্র ছিল, আমরা তিন গোয়েন্দা সিরিজের বইগুলো অদল-বদল করে পড়তাম। বাড়িতে নিজের জন্য আসা এই তিন গোয়েন্দা সিরিজের বইগুলো পড়া শেষ করার পরেও প্রচুর সময় হাতে থেকে যেত, তখন বড়ো ভাই-বোনের বইয়ের স্টকেও হাত দিতাম। বোনের সংগ্রহে হাত দিতে কখনো কোনো বাধা ছিল না, কিন্তু ভাইয়ের বইগুলো ধরতে হতো ভীষণ সতর্কতার সাথে। কারণ মাসুদ রানা সিরিজের বই পড়া আমার জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। আমাদের সময় প্রচলিত ধারণা ছিল মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলো যারা পড়ে, তারা খুব বখে যাওয়া পড়ুয়া! আর স্বভাবতই, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে বেশি। আমিও সুযোগ মতো বালিশের নিচে, বইয়ের ফাঁকে, দরজার পেছনে কয়েকদিন ধরে ঢেকে লুকিয়ে চুপিচুপি একটা বই পড়ে ফেলতে পারলে খুব গৌরব বোধ করতাম মনে মনে। এছাড়াও অবসরে অন্য বই হাতের কাছে না পেয়ে পড়ে ফেলেছিলাম মধুসূদন দত্তের “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ” এবং “একেই কি বলে সভ্যতা” নামের দুটি প্রহসন রচনা। আর, “শরৎচন্দ্র রচনা সমগ্র ১” শেষ করেছিলাম কলেজে উঠার আগেই। মোটামুটি এই হচ্ছে আমার কিশোর বয়সে বই পড়ার কাহিনি।
স্কুল শেষ করে ভর্তি হলাম হলিক্রস কলেজে। স্কুল বান্ধবী ফরিদা আর আমি একসাথে নতুন কলেজে প্রথম বর্ষে পেলাম একজন নতুন বন্ধু- অন্তরা মিতুকে। মিতু সাংস্কৃতিক পরিবারে বেড়ে উঠা মানুষ। ছোটবেলাতেই সে পড়ে ফেলেছে অসংখ্য ভালো বই। অনেক বড়ো কবি, লেখকদের রচনা সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান রাখে দেখে মনে মনে সমীহ করতাম মিতুকে। পরিচয় হবার কিছুদিনের ভেতর অনেক নতুন বইয়ের নাম জানলাম। আমাদের আলাপের বেশিরভাগটাই ছিল বই নিয়ে। আমরা দুজন কমিক, উপন্যাস, আর নাটকের সংলাপ পাল্টাপাল্টি ছুড়তাম দুজনের দিকে। মিতুর কারণে আমি কবিতা পড়তে আরম্ভ করি ১৯৯৫/৯৬ সালে। কবিতা নিয়ে সেই সময় আমাদের দুজনের আলাপ, আলোচনা, তর্ক, বিশ্লেষণ, সর্বোপরি কবিতার প্রতি ভালোবাসা আমাকে সম্পূর্ণভাবে টেনে নিয়েছিল কবিতায় জগতে। রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা থেকে শুরু করে মহাদেব সাহা, সৈয়দ হক, জয় গোস্বামী, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদ, তসলিমা নাসরিন, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং আরো অনেক কবির অসংখ্য কবিতা মুখস্ত করে ফেলেছিলাম দুজন। আমাদের কলেজের গেটের বাইরে উল্টো দিকের রাস্তায় দুটো স্টেশনারি শপ ছিল। সেখানে বই, খাতা, কলম, রাবার ইত্যাদি পাওয়া যেত। আমি আর মিতু একদিন কলেজ শেষে দোকানে গিয়ে বললাম, আপনার কাছে কি কবিতার বই আছে?
"কবিতার বই তো নাই।" দোকানের লোকটি বলে। তারপরেই আবার বললো, "না, না, আছে। একটি কবিতার বই আছে আমার কাছে।"
"দেখান তাহলে।"
লোকটি তার পেছনের সেলফে রাখা অনেকগুলো বইয়ের ভেতর থেকে দোকানের একমাত্র কবিতার বইটি বের করে আনলেন। হাতের ন্যাকড়াটি দিয়ে বইয়ের ধুলো মুছে আমাদের সামনে এগিয়ে দিলেন। সেটি ছিল রবীন্দ্রনাথের "শেষের কবিতা।" আমি আর মিতু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।
"আচ্ছা, ঠিক আছে বইটি রাখুন। আমরা আসলে অন্য কবির বই খুঁজছি।"
এই সময় পরিচয় হয় বুদ্ধদেব বসু এবং উৎপলকুমার বসুর কবিতার সাথে। বয়সের কারণে হবে হয়তো, বুঁদ হয়ে থাকতাম তাদের কবিতার অজস্র শব্দমালার ভেতর।
জীবনানন্দ দাস অন্যতম পছন্দের কবি হিসেবে হৃদয়ে আসন গেড়েছেন আরো পরে, এখনো আছেন। ছোট ছোট চিরকুটে কবিতার লাইন লিখে দিতাম আমি আর মিতু একে অন্যকে। মিতুর হাতের লেখা ভীষণ সুন্দর ছিল, কবিতা চালাচালির সাথে সাথে আমার অবচেতন মনে আরেকটি প্রচেষ্টা ছিল ওর হস্তাক্ষর নকল করা।
কবিতা এবং লেখালিখি সংক্রান্ত আরেকটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। মিতু আর আমি চিঠি লিখতাম। একদিন ইংরেজি ক্লাস চলাকালীন সময়ে পেছনের চেয়ার থেকে আমি মিতুকে একটা চিঠি পাঠালাম কয়েক চেয়ার সামনে বসা মিতুর কাছে। পরপর ছয় কি সাতজন ছাত্রীর হাত বদল হয়ে চিঠিটি যখন মিতুর কাছে পৌঁছেছে তখন সেটি ইংরেজি ম্যাডামের চোখে ধরা পড়ে গেল। অন্যের চিঠি পড়া অভদ্রতা, এই নিয়মটি অমান্য করে ইংরেজি ম্যাডাম আমার লেখা চিঠিটি খুলে পড়ে ফেললেন। এবং নিয়ম মতো যত্ন করে লেখা আমার সেই মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরের চিঠিটি সাংঘাতিক এক অপরাধ বলে গণ্য হলো ম্যাডামে কাছে। ক্লাস চলাকালীন সময়ে চিঠি চালাচালির অপরাধের চেয়েও গুরুতর ছিল চিঠির লেখা। কারণ সেই চিঠির একেবারে নিচে জয় গোস্বামীর "মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়" কবিতার কয়েকটি লাইন লেখা ছিল যে!
"তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?
কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?"
কলেজ ছাত্রী হয়ে কবিতার এমন লাইন লেখার কারণে গুরুদণ্ড হিসেবে আমাকে কলেজের সিস্টার পলিনের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল কয়েক মিনিট। এবং সিস্টার পলিনের কড়া ধমকও খেতে হয়েছিল মনে আছে।
আমাদের স্কুল কলেজ এমনকি ভার্সিটি লাইফেও জন্মদিনে বন্ধুকে বই উপহার দেওয়ার একটি চমৎকার প্রথা প্রচলিত ছিল। দোকানে আসা নতুন বইগুলো বন্ধুকে উপহার দিয়ে বন্ধুর সংগ্রহে আভিজাত্য যুক্ত করে আনন্দিত হতো কাছের বন্ধুরা। এখনো ঢাকায় গেলে বুকসেল্ফ খুললে উপহার পাওয়া বেশ কিছু বই দেখতে পাই। সময় চলে গিয়েছে অনেক অনেক পেছনে কিন্তু এই বইগুলোর ভেতরে লেখা বন্ধুর হাতের কয়েকটি লাইন এখনো অবলীলায় টেনে নিয়ে যায় সেই সময়ের মধুর স্রোতে। উপহার পাওয়া বইগুলোর ভেতর মনে পড়ছে বুদ্ধদেব গুহের “চাপরাশ”, “পারিজাত পারিং”, আশাপূর্ণা দেবীর “সুবর্ণলতা”, হুমায়ুন আহমেদের কয়েকটি উপন্যাস, কবিতার গ্রূপ মুক্তবাকের বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া “নজরুল রচনা সমগ্র” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নিজের কৈশোরের বই পড়ার ইতিহাস থেকে আমার মনে একটা বিশ্বাস জন্মেছিল যে ছোটবেলা থেকে পাঠের অভ্যাস গড়ে দিলে বাচ্চারা বইয়ের প্রতি আগ্রহী হয়। আমার বড়ো মেয়েটি যখন বানান করে পড়তে শিখলো তখন থেকে আমি ওকে প্রচুর বই কিনে দিতাম। ওর জন্মদিনে বই কিনে উপহার হিসেবে দুটো লাইন লিখে দিতাম। শপিং মলে গেলে খেলনার বদলে বই কিনে আনতাম। একদিন মেয়ে আমাকে বলে, "মা, তুমি আমাকে বই ছাড়া কিছুই কিনে দাও না কেন?" তখন আমিও ভাবলাম, তাই তো! মেয়েটাকে আমি শুধু বই-ই কিনে দেই সবসময়। সে চাইলে তো দেই-ই, না চাইলেও জোর করে বই কিনে দিচ্ছি। তখন বুঝলাম আসলে বই কিনতে আমার নিজেরই ভালো লাগে, তাই ওকে ওতো বই কিনে দিতাম অনেকটা নিজের আনন্দের জন্যেই। আর সত্যি, ছোটবেলা থেকেই আমার মেয়েটির বই পড়ার মারাত্মক নেশা তৈরি হয়ে গেল। ওর ঘরে এখন কাপড়ের চেয়ে বইয়ের সংখ্যা বেশি।
কিন্তু আমার ছোটোমেয়ের বেলায় বইপ্রীতির এই নিয়মটি কাজ করলো না। ছোটোমেয়ের বয়স এখন সাড়ে নয়। অন্যান্য সকল কাজে তার অপরিসীম আগ্রহ থাকলেও বই পড়ার প্রতি তার ভীষণ অনীহা। অনেক জোরাজুরি করেও দুই পৃষ্ঠার বেশি বই পড়াতে পারি না ওকে। তবুও আশায় আছি, হয়তো ভবিষ্যতে বড়োবোনের দেখাদেখি সেও বই পড়তে ভালোবাসবে।
২০০৬ সালে ইংল্যান্ডে আসার পর আমার বই পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেকদিনের জন্য। তার প্রধান কারণ ছিল এখানে বাংলা বই পেতাম না। দ্বিতীয় এবং অন্যান্য কিছু কারণের ভেতর ছিল অত্যাধিক কর্ম ব্যস্ততা, অবিবাহিত থেকে বিবাহিত জীবনে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা, সম্পূর্ণ নতুন একটি দেশে নিজের শিকড় শক্ত করার সংগ্রামে লিপ্ত থাকার মতো আরো কিছু বিষয়। ২০১৯ সালের শুরুতে পেন্ডামিকের কারণে মোটামোটি সমগ্র পৃথিবীতে লক ডাউন জারি হলো যখন, তখনই হাতে চলে এলো অফুরন্ত অবসর। ঠিক যে অবসরের জন্য অনেকদিন অপেক্ষায় ছিল আমার মন। অবসর সময়টুকুকে সর্বোত্তমরূপে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে অনলাইনে, অফলাইনে বিভিন্নজনের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করে পড়তে শুরু করি। এবং এবার আগের চেয়েও বেশি করে ডুবে গেলাম বইয়ের জগতে। গত দুই বছরে এমন একটি দিন নেই যেদিন আমি এক পাতা অন্তত না পড়ে ঘুমাতে গিয়েছি।
বর্তমানে নিজের পছন্দের তালিকায় আছেন বেশ কয়েকজন লেখক। যখনই দেশে যাই, চেষ্টা করি কিছু বই সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। বাড়ি ফিরে সুটকেস খুলে যত্ন করে গুছিয়ে রাখি মূল্যবান বইগুলোকে বাড়ির সুরক্ষিত কোথাও, লোকচক্ষুর আড়ালে। বেড়াতে আসা অতিথিদের চোখে যেন না পড়ে যায় আমার সংগ্রহের বইগুলো। পড়ুয়া কাউকে বই ধার দিতে আপত্তি নেই, কিন্তু বই যদি আর ফেরত না আসে, সেই ভয়ে নিজের সম্পত্তি নিজের কাছেই লুক্কায়িত থাকুক, এই নীতি অনুসরণ করি আমি। লুকানো সংগ্রহশালা থেকে একটি করে বই বের করে আনি এবং সময় নিয়ে ধীরে ধীরে আয়েস করে পড়ি পছন্দের বইগুলো। এভাবে একেকটি বইয়ের সঙ্গে চলে আমার কয়েকটি দিনের অন্যরকম পরিভ্রমণ। দীঘির ঠান্ডা জলে আঙ্গুল ছোঁয়ালে জল যেমন ধীরে ধীরে টানতে থাকে গোটা হাত আর আস্ত শরীরটিকে নিজের ভেতর, ঠিক তেমনি একটি ভালো বই পাঠককে টেনে নেয় গল্পের মর্মমূলের দিকে। বই পাঠককে স্পর্শ করে আনন্দ দিয়ে, মায়ায়, ভালোবাসায়, ঘৃণায়, তিরস্কারে, এমনকি লেখকের গল্পের মানবিক অবক্ষয়ের কষাঘাত দীর্ণ করে পাঠকের নিপাট ব্লাশনে উজ্জ্বল সৌখিন দুই গাল।
বই সভ্যতার প্রতীক। বই মানুষের প্রিয় বন্ধু। যখন অনেক খুঁজেও মনের মতো একটি বন্ধু পাওয়া যায় না, তখন মনের মতো একটি বই মিটিয়ে দিতে পারে এই বন্ধুহীনতার শূন্যতা। যখন খুব চেনা আত্মীয়টি আচমকা বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে, তখন বইয়ের কাছে আত্মসমপর্ণ করা যায় সম্পূর্ণ আত্মনিমগ্নতায়। তাই বলি, বইয়ের রাজ্য হোক মানুষের বিচরণের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। অনেক বইয়ের নাম এখনো আমার তালিকায় লেখা আছে, গভীর আগ্রহের সাথে বিপুল অপেক্ষায় আছি, পুস্তক তালিকায় লিখে রাখা সবগুলো বই একদিন পড়া হবে নিশ্চয়।