পড়ুয়া

Share this post

বই বন্ধু

www.porua.net

Discover more from পড়ুয়া

বই নিয়ে পাঠকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো প্রকাশের তেমন সুযোগ থাকে না। পাঠকের বলা না হয়ে ওঠা সেইসব কথাগুলো প্রকাশের ভাবনা থেকে আমরা শুরু করছি পাঠকের জন্য "পড়ুয়া"।
Over 2,000 subscribers
Continue reading
Sign in

বই বন্ধু

মোহছেনা ঝর্ণা লিখছেন; বয়সের ব্যবধান ঘুচিয়ে নিঝুম আপুর সাথে আমার দারুণ সখ্য গড়ে উঠলো। নিঝুম আপু যেসব বই পড়তো সেগুলোর গল্প আমাকে বলতো। মার্ক টোয়েন এর বইচুরির গল্প শোনাতো।

Aug 4, 2023
1
Share this post

বই বন্ধু

www.porua.net
Share
বই বন্ধু - মোহছেনা ঝর্ণা
বই বন্ধু - মোহছেনা ঝর্ণা

ফাগুনের কোনো এক হিম বিকেলে যখন পিচঢালা সরু রাস্তাটা পেরিয়ে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম প্রথমেই চোখ আটকে গেছে বোগেনভিলিয়ার ঝাড় দেখে। আরেকটু এগিয়ে দেখি এ যেন ফুলের মেলা। গোলাপ, রজনীগন্ধা, কসমস, অলকানন্দাসহ নাম না জানা হরেক ফুলের জলসা। পাতাবাহারেরও কমতি নেই। আব্বা জিজ্ঞেস করলো, নতুন বাসা পছন্দ হয়েছে?
এক কথায় জবাব রেডি ছিল। অনেক!
নতুন বাসায় ওঠার তিন চারদিনের মধ্যেই বিল্ডিংয়ের সব বাসার মানুষজনের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে। সব বাসা বলতে বাড়িওয়ালা আর আমরা বাদে তিন পরিবার। তারাই পরিচিত হতে এসেছিল তাদের নতুন প্রতিবেশীর সাথে। এখনকার দিনে এই কথা মানবে আমার সন্তানেরা! প্রতিবেশীর সাথে পরিচিত হতে যায় নাকি কেউ! কিন্তু সত্যিই এমনটি ঘটেছে। তখন বিল্ডিংয়ে নতুন কেউ এলে আমরাও দেখতে যেতাম তাদের। কোথ থেকে এলো? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? আগের বাসা ছাড়লো কেন? নতুন বাসার সুবিধা অসুবিধা এইসব সাধারণ কথাবার্তা।

আপনিও পড়ুয়া'য় লিখুন। আমাদের কাছে লেখা পাঠাবার ঠিকানা editor@porua.net


বিল্ডিংয়ের একতলার ভাড়াটিয়ার মেয়ের নাম ছিল নিঝুম। আর ছেলের নাম ছিল গালিব। এদের সাথে অন্যদের তফাৎটা খুব সহজেই চোখে পড়তো। ওদের বাসায় গিয়ে চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল ঘরসজ্জার বাহার দেখে। বিভিন্ন রঙের মাটির পটারি ঘরের সামনে। ঘরে ঢুকতেই নানা রকম ফুলের টবে নানারকম রঙিন ফুলের সমাহার। বসার ঘরটা জুড়ে শুধু বই আর বই। ছোট বড় বিভিন্ন সাইজের বুকশেলফ। সেখানে আবার তাকে তাকে স্টিকার লাগানো। নিঝুম আপু ক্লাস নাইনে পড়তো। ক্লাস ফোরে পড়ুয়া আমি বিস্ময় ভরা চোখে তাকে জিজ্ঞেস করি, এত বই কার?
নিঝুম আপু মুচকি হেসে বলে, যারা লিখেছে তাদের।
আরেহ না। সেটা তো বুঝছি। কিন্তু তোমাদের বাসার বইগুলো কাদের?
-আমাদের সবার।
-সবার মানে?
-আব্বু, আম্মু, আমার, গালিবের। কেন, তোমাদের বাসায় বই নেই? তোমরা বই পড় না?
হ্যাঁ পড়ি তো! স্কুলে যে বইগুলো আছে সেগুলো পড়ি। আবার আমার আব্বা ম্যাগাজিন পড়ে ওগুলো আছে।
নিঝুম আপু অবাক হয়ে বললো, আর কোনো বই নেই?
-না। আর তো কোনো বই নেই।
এরপর নিঝুম আপু নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে আমাকে একটা করে বই পড়তে দিতো। প্রথম দিকে বেশির ভাগই ছিল গোপাল ভাঁড়ের গল্প, নাসিরউদ্দিন হোজ্জার গল্প। রাক্ষস খোক্কসের গল্প। ঈশপের গল্প। তারপর একদিন দিল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর "ঠাকুরমার ঝুলি", নীহার রঞ্জনগুপ্তের "হীরা চুনি পান্না", বন্দে আলী মিয়ার কবিতা, কালীপদ দাশের মুক্তিযুদ্ধের গল্প।আরও দিত বিদেশি গল্পের অনুবাদ। এখন আর অনেক বইয়ের নামই মনে নেই। সব বইয়ের সব গল্প, সব লেখা ঠিক সেভাবে বুঝে উঠতে পারতাম না। কিন্তু বই পড়তে ভালো লাগতো। কারণ বই পড়ার ছলে নিঝুম আপুদের বাসায় আমার নিয়মিত যাওয়ার সুযোগ হতো। ওদের বাসায় সবার অবাধ যাতায়াত ছিল না। বিল্ডিংয়ের সবার সাথে ওদের সুসম্পর্ক থাকলেও সেরকম মাখামাখি ছিল না। আবার এখন আমি বুঝি সেসময় ওদের রুচির সাথে হয়তো অন্যরা ঠিক সেভাবে তাল মেলাতে পারতো না বলেই একটা দূরত্ব ছিল। নিঝুম আপুর সাথে কাটানো প্রায় দুইবছরের সময়টা আমার নিজের জীবনকে অন্যভাবে দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল।

বয়সের ব্যবধান ঘুচিয়ে নিঝুম আপুর সাথে আমার দারুণ সখ্য গড়ে উঠলো। নিঝুম আপু যেসব বই পড়তো সেগুলোর গল্প আমাকে বলতো। মার্ক টোয়েন এর বইচুরির গল্প শোনাতো। বলতো, মার্ক টোয়েন এর বাসায় নাকি কোনো বুকশেলফ নেই। মার্ক টোয়েন নাকি বলতো, বইগুলো যেভাবে যোগাড় করেছি, বুক শেলফ তো সেভাবে যোগাড় করার সুযোগ নেই। এই গল্প মনে করে কত দিন মনের অজান্তেই ফিক করে হেসে দিয়েছি আমি। ঈশপের গল্প শোনার পর আবার আলাদা করে মোরালিটি শোনার জন্য অপেক্ষা করতাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নজরুলের কবিতা, জীবনানন্দের কবিতা এত সুন্দর করে আবৃত্তি করতো যে আমি অতটুকুন বয়সে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। নিঝুম আপু আমার কাছে ছিল এক ঘোরের নাম। এক মায়ার নাম। এক নেশার নাম।

একদিন দুপুরে ওদের বাসায় গিয়ে দরজা নক করতেই নিঝুম আপু দরজা খুলে বললেন, তাড়াতাড়ি আয়। আমার ভাত পুড়ে যাচ্ছে। আমি দৌড় দিয়ে তার পিছু পিছু গিয়ে দেখি রান্নাঘরে চুলায় একটা পাতিলে ডিম আর ভাত একসাথে ভেজে নিচ্ছে। খাওয়ার মেন্যু দেখে আমার চোখ কপালে ওঠার দশা। নিঝুম আপুর হাতে তখনো বই। বলে, আম্মু ভাত রান্না করে গেছে। আজ খুব তাড়া ছিল। তাই অন্য তরকারি রান্না করতে পারেনি। তাছাড়া আজকে আমার মেন্যুতে ডিম ছিল। তাই ডিম ভাজার সময় ভাতগুলোও দিয়ে দিলাম। খেতে খারাপ হয় না। আগেও খেয়েছি আমি। খাবি আমার সাথে? বললাম, না। তুমিই খাও। খাবার তো পুড়েও গেছে। আরে চুলায় ভাত দিয়ে বইটা খুলে বসলাম হঠাৎ পোড়া গন্ধ পেয়ে এসে দেখি ভাত পুড়ে শেষ। তাই ভেজে নিচ্ছি। পোড়া গন্ধ লাগবে না।

আমি বলি, আম্মা আজকে কাঁঠাল বিচির ভর্তা করেছে। শোল মাছের ঝোল করেছে আলু দিয়ে। সাথে আবার শুঁটকিও আছে। তোমার জন্য কিছু নিয়ে আসি?
না রে। খাবার দাবার নিয়ে আমার কেন জানি তেমন সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় এই সময়ে যদি আরেকটা বই পড়তে পারি, তাহলে আরও কত কিছু জানতে পারবো। রান্নাঘরের একপাশে দেখি একটা ছোট বইয়ের তাক। সেখানে বিভিন্ন রকম বই। পাশে বাঁধাই করা খাতা। তাকের একপাশে চার্ট ঝুলানো। সেখানে দেখি সপ্তাহে কি বারে খাবারের মেন্যু কি হবে তার চার্ট। এই জিনিস দেখে আমার টাসকি খাওয়ার যোগাড়। চার্ট করে খাওয়া যায় নাকি আবার! নিঝুম আপু বললো, আম্মু পুষ্টি বিভাগে কাজ করে তো তাই প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় যেন সুষম খাবার থাকে মূলত সেজন্য চার্ট।
নিঝুম আপুর কথা শুনে হাসতে হাসতে শেষ আমি।

শুক্রবার ছাড়া নিঝুম আপুকে বেশি সময়ের জন্য পাওয়া যেতো না। কারণ স্কুলের পড়ালেখা, প্রাইভেট টিচার, বাড়ির কাজ নিয়ে সব সময় ব্যস্ততার ভেতর ই থাকতে হতো তাকে। তবু আমার দিন চলে যাচ্ছিল বিপুল আনন্দে। আমি প্রতি সপ্তাহে বই আনতাম।শুক্রবারে গিয়ে আগের বই জমা দিয়ে নতুন বই আনতাম। "পদ্মা নদীর মাঝি" নামটা দেখেই এই বইটা ওদের তাক থেকে নিয়েছিলাম। রিডিং পড়ে গেছি কিন্তু কিছু বুঝিনি। পরে এক শুক্রবার বিকালে নিঝুম আপু পদ্মা নদীর মাঝি'র গল্পটা বললেন। কুবের মাঝির কষ্টের কথা বললেন। হোসেন মিয়ার চালাকির কথা বললেন। সেই ক্লাস ফোর এ পড়ুয়া আমার মনে পদ্মা নদীর মাঝি আঁকা হয়ে গেছিল অন্যরকম এক মায়ায়। পরে বড় হয়ে পদ্মা নদীর মাঝি পড়েছি। সিনেমা দেখেছি। সবই অসাধারণ। কিন্তু নিঝুম আপুর মুখের সেই গল্প ছিল অনন্য।
নিঝুম আপুর সাথে কাটানো দু'বছরের সেই সময়টুকু আমার জীবনে ভিন্ন এক সূচনা করে। আমার চঞ্চল কিশোরী মনে সেই স্মৃতি টুকু দারুণ ভাবে দাগ কাটে। বাসা বদলের দুঃখের অনেক স্মৃতির সাথে নিঝুম আপু কে হারিয়ে ফেলার স্মৃতিটাও ক্ষত-বিক্ষত করে আজও আমাকে।

আমাদের আর দেখা হয়নি কখনো। কিন্তু আমার বই পড়ার অভ্যাসটা তৈরি হয়ে গেছে ততদিনে। আমাদের হাই স্কুলে লাইব্রেরি ছিল। সেখান থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার একটা করে বই বাসায় নিয়ে আসতাম। স্কুলের পাশেই ছিল মার্কেট "লাকী প্লাজা"। সেখানে "বুক এমপোরিয়াম" নামে একটা বইয়ের দোকান ছিল। আবার স্কুলের পাশেই ছিল "কথাকলি লাইব্রেরি"। স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বই কেনা শুরু তখন থেকে। হুমায়ুন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শীর্ষেন্দুর বই ই বেশি পড়তাম। "পথের পাঁচালী"র দুর্গার জন্য হু হু করে কেঁদেছি। ছোট্ট অপুর জন্য মনটা ভার হয়ে গিয়েছিল। একই বই কত বার যে পড়েছি! "পুতুল নাচের ইতিকথা"র কুসুম, কুমুদ, শশী ডাক্তার.... । সেই বয়সের পছন্দের বই ছিল "কালবেলা", "গর্ভধারিণী", "কাছের মানুষ"। কোনো এক জন্মদিনে আমার দুই ভাইয়ের যৌথ উপহার ছিল "সঞ্চয়িতা" আর "গল্পগুচ্ছ"। স্কুলে পড়ার সময় এবং পরে কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে বন্ধুদের জন্মদিনে উপহার হিসেবে বইয়ের খুব কদর ছিল আমাদের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বান্ধবীর কাছ থেকে উপহার পাওয়া আনু মুহাম্মদ এর অনুবাদে ওরিয়ানা ফাল্লাচি'র বই "হাত বাড়িয়ে দাও" ভিন্ন একটা আমেজ দিয়েছিল। হাত বাড়িয়ে দাও পড়তে গিয়ে বারবার নিঝুম আপুর কথা মনে পড়ছিল।
মানুষের জীবনের কোন সময়টা যে কার স্পর্শে রঙিন এবং খুবই বিশেষ হয়ে উঠে তা বড়ই রহস্যময়। আমি আমার জীবনের আনন্দের কথা বলতে গেলেই বুঝি বইয়ের স্পর্শের কথা। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে সব মানুষের জীবনেই হয়তো কোনো নিঝুম আপু থাকে যারা নিজের অজান্তেই অন্যের জীবনকে গড়তে ভূমিকা রাখে। এই পরিণত বয়সে এসে প্রায়ই মনে হয়, জীবনে "বই বন্ধু" থাকলে একটা জীবন অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায় সকল দুঃখ-কষ্টকে উপেক্ষা করে।

বই নিয়ে পাঠকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো প্রকাশের তেমন সুযোগ থাকে না। পাঠকের বলা না হয়ে ওঠা সেইসব কথাগুলো প্রকাশের ভাবনা থেকে আমরা শুরু করছি পাঠকের জন্য "পড়ুয়া"। ইমেলে যুক্ত থেকে আমাদের সাথে থাকার অনুরোধ রইলো।

1
Share this post

বই বন্ধু

www.porua.net
Share
Previous
Next
Comments
Top
New
Community

No posts

Ready for more?

© 2023 Riton Khan
Privacy ∙ Terms ∙ Collection notice
Start WritingGet the app
Substack is the home for great writing