বইয়ের আমি, আমার বই
চয়ন মল্লিক | বই আমার পরম বন্ধু। যে কোন সময়েই আমি ডুবে যেতে পারি বইয়ের জগতে। আমার অসীম তৃষ্ণা মেটাতে পারে শুধুই বই। বই পড়া শুরু করেছি বলা যায় অক্ষর চিনবারও আগে। মায়ের কাছে শুনেছি ছবি দেখে গল্প বলে
বই আমার পরম বন্ধু। যে কোন সময়েই আমি ডুবে যেতে পারি বইয়ের জগতে। আমার অসীম তৃষ্ণা মেটাতে পারে শুধুই বই। বই পড়া শুরু করেছি বলা যায় অক্ষর চিনবারও আগে। মায়ের কাছে শুনেছি ছবি দেখে গল্প বলে যেতাম আমি—কেউ নাকি গল্পে কোন ভুল করতে পারত না। ভুল করলে বা বানিয়ে বললেই কেঁদেকেটে বাড়ী মাথায় করতাম। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতেই বোধহয় আমাকে বইয়ের আলমারি খুলে বসিয়ে দেওয়া হত। আমি ইচ্ছামত বই নামাতাম, ছবি দেখতাম, আর এভাবেই পড়তে শিখে গেছি বোঝার আগেই। সেই না-বোঝা-বয়স থেকে এখন পর্যন্ত এমন একটি দিন যায়নি যে আমি বই ছাড়া থেকেছি। একদিন বই না পড়লে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, মনে হয় আমি যেন ডাঙায় তোলা মাছ—জলের অভাবে খাবি খাচ্ছি। জীবনের যত ওঠাপড়া, যত ঘাত প্রতিঘাত, সুখদুঃখ—সবকিছুতে আমাকে আশ্রয় দিয়েছে বই। তাই আক্ষরিক ভাবেই “বই আমার নিত্যসঙ্গী” কথাটি আমার জীবনে সত্যি। আমার বিভিন্ন ঘরে—হ্যাঁ, বাথরুম সহ—বিভিন্ন বই থাকে। যখন যে ঘরে বসি, সেই বই পড়ি। তাই সত্যিই বই আমার নিত্যসঙ্গী।
আমার প্রিয় লেখকের তালিকা খুব দীর্ঘ, কারণ আগে পড়তাম শুধু বাংলা, আর এখন সঙ্গে যোগ হয়েছে ইংরেজিও। আর বাংলা ও ইংরেজী এই দুই ভাষাতেই এত ভালো ভালো লেখক আছেন, যে আমার পক্ষে দুই-একজনের নাম করা মুশকিল। সবরকমের বই-ই আমার প্রিয়, তবে সবচেয়ে বেশী পছন্দ রহস্যোপন্যাস বা রোমাঞ্চোপন্যাস। আমাকে যদি বইয়ের দোকানে বা লাইব্রেরিতে ছেড়ে দেওয়া হয়, আমি সোজা চলে যাই একটি বিশেষ দিকে—রহস্যোপন্যাস বিভাগ। কেন যে সব রকমের রহস্য আমায় এতো টানে, জানিনা। তবে সেটা হতেই হবে একদম জমজমাট রহস্য—হোক তা মার্ডার মিস্ট্রি, বা অন্য কিছু। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টেনে রাখতে পারতে হবে আমায়—তবেই না মন-মগজ সব একসাথে সতেজ হয়ে উঠবে!
কে আমার প্রিয় গোয়েন্দা? হুম, জটিল প্রশ্ন। আধুনিক যুগে বাঙালী গোয়েন্দাদের মধ্যে নির্দ্বিধায় ফেলুদা’র নাম করবো, আর পুরনো গোয়েন্দাদের মধ্যে তো অবশ্যই ব্যোমকেশ। কিরীটি রায়ও মন্দ নন। ইন্দ্রনীলকে চেনেন কি কেউ? অদ্রিশ বর্ধনের সৃষ্টি। আছেন কাকাবাবু, অর্জুন, মিতিনমাসী। রয়েছে গোয়েন্দা শবর। নতুন এসেছেন দীপকাকু—তিনিও খারাপ নন।
আর বিদেশীদের মধ্যে—না, শার্লক হোমস নন—তবে আমার প্রিয় দুজনই পুরনো আমলের গোয়েন্দা। শার্লক হোমস অপ্রিয় নন, তবে কেন জানিনা আমার তেমন মন টানে না। যদিও প্রতিটি গল্পই পড়েছি অনেকবার!
আমার প্রিয় গোয়েন্দা দুজনেই একই লেখকের সৃষ্টি। একজন মাত্র ঔপন্যাসিক কি ভাবে একই সাথে দুই দুইজন বিখ্যাত গোয়েন্দা আমাদের মত পাঠকদেরকে উপহার দিলেন—ভাবতেও আশ্চর্য হই! সেই সাথে তাঁর সৃষ্ট আরো কয়েকজন ছোটখাট সত্যান্বেষী তো আছেই। বলুন তো তাঁর নাম কি? বলা হয় এঁর লেখা বই “অল টাইম বেস্টসেলার”, বলা হয় বাইবেল আর শেক্সপীয়রের পরেই সবচেয়ে বেশী ছাপা হয়েছে এই লেখকের বই। বিশ্বের প্রায় সব ভাষাতে অনুবাদও হয়েছে তাঁর বই-ই সবচেয়ে বেশী। হ্যাঁ—তিনি আগাথা ক্রিস্টি। আর তাঁর অমর সৃষ্টি দুই বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দার একজন হলেন বেলজিয়ান ডিটেকটিভ এরকুল পোয়ারো, আর অন্যজন হচ্ছেন ইংল্যান্ডের ছোট্ট এক অখ্যাত গ্রাম সেইন্ট মেরী মীডের অধিবাসিনী বৃদ্ধা মিস মার্পল। এঁদের নিয়ে লেখা প্রতিটি কাহিনী অসংখ্যবার পড়লেও পুরনো হয় না।
আমার খুব পছন্দের আরেকজন লেখক ড্যান ব্রাউন। ওঁর লেখা রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের তুলনা হয় না! প্রতিটি কাহিনী লিখতে যে কী পরিমান রিসার্চ করেন উনি, তা ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে আমার কাছে। শুধু দ্য দা ভিঞ্চি কোড-ই আমি পড়েছি অন্ততঃ বার পাঁচেক। অবশ্যই ইংরেজীটা। প্রতিবারই আগের চেয়ে বেশী ভাল লেগেছে।
বই নিয়ে গল্প শুরু করলে একবারে তো শেষ হবার নয়, তাই একটা বিশেষ সময়ের একটু গল্প করছি এবারে। আমার মেয়ে হবার সময়টুকুর পুরোটাই আমাকে কাটাতে হয়েছে পরিপূর্ণ বিশ্রামের ভেতর—অর্থাৎ বিছানায়। সে সময়টায় সারাদিন কাটানোর জন্য বই আর গান, এ দুটোই ছিল আমার সঙ্গী।
কত বই যে আমি পড়েছি ওই কয়েকমাসে, তার ইয়ত্তা নেই! প্রথমে রিভাইস করেছি বঙ্কিম, তারপর রবীন্দ্রনাথ (অবশ্য শুধু গল্প আর উপন্যাসগুলো), শরৎচন্দ্র, তারপর ঘরে মোটামুটি যা যা ছিল, সব—সত্যজিৎ, বাণী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, বুদ্ধদেব, আরো যত ছিল, তারপর পুরনো সব শারদীয়া সংখ্যাগুলো; এরপর ধরলাম যত জাফর ইকবাল, শাহরিয়ার কবির, হুমায়ূন আহমেদ, তারপর মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, অনুবাদ—যা ছিল সব আবার পড়ে গেছি একধার থেকে। বাসার সব যখন শেষ হওয়ার পথে, ঠিক তখনই আমার জন্মদিনে পেলাম এ পর্যন্ত পাওয়া সব জন্মদিনের চেয়ে বেশী বই। আমার খুশী দেখে কে!
সেবারই আমি একবারে পেলাম পুরো শরদিন্দু সমগ্র!! একটা খণ্ডে সব উপন্যাস, একটায় সব ঐতিহাসিক উপন্যাস, আর আরেকটা শুধুই ব্যোমকেশ! উফ, সে যে কী আনন্দ! ভাবলে এখনও মন ভালো হয়ে যায়। ওগুলো সব আমার মা-বাবা, ভাই-বোন আর আমার বর দিয়েছিল। আরো অনেক বই পেয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলো তত ভাল মনে নেই। এগুলো মনে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে যে, খুবই আশ্চর্যজনক হলেও, ব্যোমকেশ আমার আগে পড়া ছিল না। অন্যান্য উপন্যাস এদিক ওদিকে মিলিয়ে পড়ে ফেলেছিলাম, কিন্তু কোন অদ্ভুত কারণে ব্যোমকেশবাবু আগে আমায় সেভাবে টানেন নি। সেবারে এমন টানেই টানলো যে উনি এখন আমার সাথেই ক্যানাডা থাকেন!
আমি নিজে ওই সময়ে বই কিনতে পারিনি তো কি হয়েছে! বই ডাবল হবে তেমন ভয় আমার ছিল না, কারণ আমার বইয়ের দোকানদার (যেন আমারই দোকান আর কি!) আমাদের সবাইকে তো বটেই, এমনকি আমার বন্ধুদেরকেও চিনতো, আর সেই মত বই সাজেস্ট করতো যে কোনটা আমার আছে, বা নেই। আমার জন্য বই কিনতে গিয়ে লোকে আমার চেয়ে বেশী সেই বইওয়ালাকেই বিশ্বাস করত। এখনও দেশে গেলে ওই দোকানেই যাই। অর্ডার দিয়ে দেই, আসার কয়েকদিন আগে গিয়ে নিয়ে আসি।
যাক, বইয়ের গল্প শেষ করি। এখনও দেশে গেলে ক্রমাগত বই কিনি। ফেরার সময় আমাদের তিনজনের জামাকাপড় থাকে বড়জোর একটা লাগেজে, আর হয়তো ক্যারি-অনে। বাকী যে ক’টা লাগেজ আমাদের বরাদ্দ, সব গুলো ভরে বই আনি—একদম ওজনের শেষ সীমা পর্যন্ত। মা-বাবা এলেও ওঁদের দিয়েও বই-ই আনাই। এভাবে এনে, আনিয়ে চারটা শেল্ফ ভরেছি। এদের বেশীরভাগই দুই সারিতে বই রাখা তাই চাইলেই সব দেখতে পাওয়া যায় না। না যাক—আমার কাছে আছে এরা, তাতেই আমি খুশি! আর চাইলেই আমি আমার পছন্দের বইগুলো পড়তে পারছি, এই দূর প্রবাসে সেও কি কম? ঢাকার বাসায় রাখা বইয়ের কিছুই আনতে পারিনি—ভাইবোনেরা দেয় না! সেখানে বসবার ঘরে আছে বিশাল দুটো বুকশেল্ফ, খাবার ঘরে একটা, মায়ের ঘর বাদে অন্য দুটো ঘরেই আছে একটা করে, আর বাথরুমেও আছে বুকশেলফ! সে সব বইয়ের কথা ভেবেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে—তাই এখানেই আজকের মত সমাপ্তি টানছি।।