বই পড়ার আহ্বান
বই শুধু জ্ঞান বা সৃজনশীলতা বাড়ায় না, আমাদের জীবনের অনেক দিককে সমৃদ্ধ করে। বই আমাদের একজন নির্ভরযোগ্য সঙ্গী, যার কাছ থেকে আমরা ধৈর্য, অধ্যবসায় আর সঠিক পথ চলা শিখতে পারি।
বই-পড়া মানবতার অভিযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বই চেতনাকে আলোকিত করে, জ্ঞানের অসীম সমুদ্রে ভাসায়। মানুষ কীভাবে নগণ্য প্রাণী থেকে সভ্য-সমাজ গড়ে তুলেছিল, এ রহস্যের উত্তরে বই পড়ার গুরুত্ব আরও বেশি অনুভূত হয়। বই— আমাদের অতীতের সাক্ষী, বর্তমানের প্রতিফলন এবং ভবিষ্যতের আশা।
আমরা জানি, মানুষ হিসেবে আমরাএকটা অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী— অন্যের থেকে শেখার। এই ক্ষমতার বলে-ই আমরা সভ্যতাগুলো গড়ে তুলতে পেরেছি। কল্পনা করুন, একসময় আমরাও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মতো জঙ্গলে বাস করতাম। কিন্তু আমরা ক্রমশ শিখতে শিখতে পরিবার, গোত্র, নগর, রাষ্ট্র সর্বপরি এই বৃহত্তম মানব-সমাজ গড়ে তুলেছি, নিজেদের রীতি-নীতি আর আইন-কানুন বানিয়েছি।
বই-পড়া শিক্ষা নেওয়া/পাওয়ার এক মজার উপায়, বই মানুষের জীবনেরই আয়না। কল্পকাহিনীতে অন্য চরিত্রের জীবন জুড়ে ঘুরে বেড়াই, ইতিহাসে অতীতের মানুষের কাজকর্ম জানি, বিজ্ঞানে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করি আর দর্শনে জীবনের অর্থ খুঁজে ফিরি।
আজ বিজ্ঞানের জগৎ হতে অতীতের ইতিহাস, এমনকি দূরদেশের সংস্কৃতি— সবকিছুই হাতের নাগালে। এ জাদুকরী দুনিয়ায় যাতায়াতের পথ খুলে দেয় বই, যা সকল জ্ঞানের অসীম ভান্ডার। পড়ে আমরা হাজার বছর আগের ঘটনা এক নিমিষে জানতে পারি। মানবেতিহাসে বই এক বিশেষ উপহার, আমাদের এই জটিল জগতে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে প্রভুত সাহায্য করে।
সবাই জানি, বই পড়া কেবল কাগজের পাতা উল্টানো নয় বরং মনের এক অসাধারণ অভিযাত্রা, চিন্তার জগতকে নতুন রঙে রাঙায়। যখন পড়ি, তখন লেখকের মনের ভেতরে ঢুকে পড়ি, তার চিন্তাভাবনার সাথে মিশে যাই। এই মিশেলে নিজস্ব চিন্তা আরও পরিপক্ক হয়, জ্ঞানের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
বই পড়া মানেই হচ্ছে— একই সাথে চিন্তার পেশীগুলোকে শক্তিশালী করা। বইয়ের জটিল পাতাগুলো উল্টে-পাল্টে পড়তে পড়তে নিজের মধ্যে এক বিশ্লেষক জাগরুক হয়। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আমাদের মস্তিষ্ককে চ্যালেঞ্জ করে, নতুন নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। যত বেশি পড়ি, তত বেশি জীবনের নানান সমস্যা সমাধানে সজ্জিত হই। এই ধরনের মানসিক বিকাশে বই অনন্য।
অন্যের জীবনের আনন্দ-কষ্ট, সুখ-দুঃখ, ভুল-ত্রুটি, সাফল্য-ব্যর্থতা যা হয়তো কোনোদিনই নিজ জীবনে ঘটবে না বা ঘটার সুযোগ নেই তা জানতে-বুঝতে বই বহুকাল যাবৎ আমাদের অন্যতম অবলম্বন; মানবের প্রপঞ্চ, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অবস্থানসমূহ অনুভবের সুযোগ করে দেয়। এই অভিজ্ঞতা অন্যদের প্রতি সহনশীল বা সহানুভূতিশীল করে তোলে। দীর্ঘকালের সামাজিক প্রাণী হিসেবে মানুষ অপরের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং জটিল সামাজিক-ব্যবস্থা পরিচালনায় অভ্যস্ত। বই-পড়া এই সামাজিক-বোধকে আরও সূক্ষ্ম ও শক্তিশালী করে।
আজ যখন মানুষের মনের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে, নিজেদের ভেতর ভুল বোঝাবুঝি নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার, অন্যের মন বোঝার ক্ষমতাটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে মানুষের মন নিয়ে লেখা (মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে রচিত গ্রন্থ) সমস্ত বই যেন আমাদের সকলকে একক মনের অধিকারী করে দেয়; রং-রূপ-রসে আমরা নিজেকে অপর থেকে আলাদা করলেও মনের দিক থেকে পার্থক্য যৎসামান্যই।
আজকের নব-আবিষ্কার আর সৃষ্টিশীলতা আসলে হাজার বছর পূর্বে মানব সৃষ্ট সরল সভ্যতার উপর নির্মিত। যখনই বিদ্যমান জ্ঞানের সাথে নতুনের মিশেল হয়েছে, তখনই মানবজাতি একধাপ এগিয়েছে; আর এ কাজে নিঃসন্দেহে বইয়ের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। বিভিন্ন তথ্য, তত্ত্ব, আর উপাত্ত দিয়ে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে নতুন নতুন চিন্তায় উৎসাহিত করেছে— বই। দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া বিষয়কেও দৃষ্টিসীমানার মধ্যে নিয়ে আসতে অন্যতম সহায়ক বই।
মহামানব-মহাজনরা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন হলেও চরিত্র বিশ্লেষনে সবাই একনিষ্ঠ পাঠক। মননকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে তাঁরা সবাই বইয়ের শরণ নিয়েছিলেন; জানা জিনিসকে ভিন্নক্ষেত্রে ব্যবহার করে নতুন আবিষ্কারের দ্বার উন্মুক্ত করে দিতেন। কেবলমাত্র কল্পনাকে উজ্জীবিত করাই নয় বরং মস্তিষ্ককে জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজতে আর বৃত্তের বাইরে চিন্তা করতে বই উৎসাহিত করে।
বইয়ের কর্তব্য জ্ঞান বা সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে সীমাবদ্ধ নয়, জীবনের সব দিশায় বইয়ের পদচারণা এবং সমৃদ্ধিকরণই তার স্বার্থহীন কর্ম। বই নির্ভরযোগ্য সঙ্গী— শেখায় ধৈর্য, অধ্যবসায় আর সঠিক পথ নির্বাচনের সক্ষমতা, বিশেষভাবে বললে মনোস্তত্ত্ব, জীবনবোধ, জীবনসংগ্রাম বা জগত কি, কেন আর কিভাবে চলমান তার ব্যাখ্যায় বই পারঙ্গম।
বই চিন্তার অঙ্কুর করতে, বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। মানবিকতার বিকাশ ঘটায়। চিন্তার জড়তা ত্যাগের মধ্য দিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উদয় আর মুক্তমনা গড়ে তোলে বই। নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে আজকের জগত পূর্বের তুলনায় দ্রুত পরিবর্তনশীল, এই অবস্থায় নিজেকে প্রস্তুত রাখতে নতুন কিছু জানা, বোঝা আর শেখার বিকল্প নেই, যার অন্যতম মাধ্যম বই।
একমাত্র আনন্দ লাভে বই পড়া অনেকটা আলাদিনের প্রদীপে সলতা পাকিয়ে আলো জ্বালানোর মতোই। আপন-পর, জীবন-জগত, বিজ্ঞান-ইতিহাস, সংস্কৃতি-স্বাধীনতা, দর্শন-ধর্ম, শরীর-মন ছাড়াও হাজার বিষয় জানা-বোঝা-শেখাসহ নতুনকে গ্রহণ করে জড়তাকে ত্যাগের মাধ্যমে সার্থক জীবনের স্বপ্নকে বাস্তবায়নে আমাদের একমাত্র বিশ্বস্ত এবং নিঃস্বার্থ বন্ধু বই। তাই বইয়ের সাথে দূরত্ব নয় বরং দ্রুত আপন করে জীবন গঠনের সিদ্ধান্তে বিলম্ব কেন?