পড়ুয়া

Share this post

ছিলে রাণী হলে দাসী

www.porua.net

Discover more from পড়ুয়া

বই নিয়ে পাঠকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো প্রকাশের তেমন সুযোগ থাকে না। পাঠকের বলা না হয়ে ওঠা সেইসব কথাগুলো প্রকাশের ভাবনা থেকে আমরা শুরু করছি পাঠকের জন্য "পড়ুয়া"।
Over 2,000 subscribers
Continue reading
Sign in

ছিলে রাণী হলে দাসী

রুমা মোদক

Apr 24, 2023
Share this post

ছিলে রাণী হলে দাসী

www.porua.net
Share
book lot on table
Photo by Tom Hermans on Unsplash

স্কুলের প্রাথমিক গণ্ডি পার হইনি তখন। বহুতল দালানের নিচে লুকিয়ে যাওয়া আমাদের পায়ে হাঁটার রাস্তাগুলো তখন খুব প্রিয় ছিলো আমার। ধুলোয় সাদা আঁকিবুঁকি করে জড়িয়ে নিতো আমার নীল ইউনিফর্ম। আমি তাকিয়ে থাকতাম সুতায় ঝুলানো বইয়ের সারির দিকে,স্টুডেন্ট লাইব্রেরি। সেখানে ঝুলছে একটা বই "সোনার হরিণ'। নিউজপ্রিন্টে ছাপানো রঙিন প্রচ্ছদ। একটা হরিণ ঘনঝোপ ঝাড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে। হাঁটুরে শাড়ি পড়ে একটা মেয়ে ঘুরে তাকিয়ে আছে হরিণের দিকে। প্রাইমারি গণ্ডি পেরোইনি তখনও। সেই সোনার হরিণ প্রতিদিন পিছু পিছু আমার সাথে বাসায় আসে, বাবার কাছে বায়না ধরি, বাবা আমার সোনার হরিণ চাই।

আমার ধনকাকু কলকাতা বাসী। সে বছর দেশে এলেন। আমি তাঁকে প্রথম দেখলাম। আমার আরো চার কাকার মতো আটপ্রৌরের আচরণ নয়,একটু অতিথি অতিথি বিশেষ আপ্যায়ন তাঁর। বেশ কলকাতার বাংলায় কথা বলেন, ঘরে চলা আকাশবাণীর মতো। পাঁচ বছর বয়সের আমি হা করে শুনি। ঘরে একটা প্রবাদও শুনি চুপিচুপি, মা আর পিসি বলাবলি করেন,' জামাই আইলে খাই ভালা, বুঝা যায় হিসাবের বেলা"। বাবা,মা অন্য কাকাদের মুখে হিসাবের কালো ছায়া আমার রঙিন বইয়ের অচেনা আনন্দের পৃষ্ঠাগুলো একটুও ম্লান করতে পারেনা। আমি তখন পাঁচ। সাল ১৯৭৬। হাতে পেয়েছি আবোল তাবোল, টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের "বর্ণ পরিচয়"। অদ্ভুত এক রঙ রেখায়, ছবিতে, ছন্দে আমার হাতে ধরা দিয়েছিল সোনার হরিণ, সেই পাঁচ বছর বয়সে, আমি যখন "শুনতে পেলুম পোস্ত গিয়ে, তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে ' পড়ছি কিংবা "জনি, জনি ইয়েস পাপ্পা" মুখস্থ বলি তখন আর কোনো জায়গার খবর জানিনা, নিশ্চিত জানি আমার শহরের কেউ সুকুমার রায়ের নামই শুনেনি। কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থার সাথে অপরিচিত,প্রাইমারি কেন্দ্রিক শিক্ষার্থীরা কেউ এসব রাইম কল্পলোকেও দেখেনি। কাকু কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছেন ঝকঝকে সব ছাপানো বই।

পড়ুয়া is a reader-supported publication. To receive new posts and support my work, consider becoming a free or paid subscriber.

আমার স্বল্প আয়ের বাবা পাবলিক লাইব্রেরির কার্ড করে আমাকে চিনিয়ে দিয়েছেন বইয়ের গভীর তলহীন থৈহীন রাজ্যের সাথে। আমিতো সেই সাত আট বছর বয়সেই আবিষ্কার করে নিয়েছি বই আমার আশ্রয়। আনন্দে যতোটা বেদনায় তার চেয়ে অনেক বেশি, সুখে যতোটা বিষাদে ততোধিক। আনন্দ বেদনাদেরতো সুক্ষ্ম অনুভূতির আরশিতে জানা হয়নি তখনও, তবে আবিষ্কার করেছি ঠাকুরমার ঝুলির পাতায় আঁকা ডাইনি বুড়ির ফোকলা দাঁতের ভয়ংকর ছবি আর গল্প গাথায় নিজেকে দিব্যি হারিয়ে ফেলা যায়। সব ভুলে ডুব দেয়া যায় সুঁই রাজকন্যার অন্দরে। মাথার পাশে রাখা সোনার কাঠি রূপোর কাঠির পাহারায় গভীর ঘুমে দেখতে পাই নিজেকেই, সেই নকশা করা পালঙ্কে মৃত্যুসম ঘুম, সেই ঘুমে অপেক্ষা পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্রের।

সোনার হরিণটির ডাক অগ্রাহ্য করতে পারিনি তাই,মলাট দেখে কবে থেকে যে জানতে শিখেছি এই দুই মলাটের ভেতর বাস করে বিস্ময়ের আনন্দ,আবিষ্কারের অপার বিস্ময়। মাত্র পাঁচ টাকা দামের বইটি কিনে দেয়ার বায়না ছিলো বাবার কাছে আমার প্রথম বায়না। স্বল্প বেতনের টাকায় দশজনের পরিবার টানা বাবা আমার কিনে দিতে পারেননি বইটি। বইটি আমাকে কিনে দিয়েছিলেন পিসেমশায়। একটা বইয়ের বায়না দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন তিনি।

বায়না আর ধরেছি বলে মনে পড়েনা, এদিক সেদিক থেকে পাওয়া যৎসামান্য টাকা জমিয়ে বই কেনার নেশা আর পিছু ছাড়েনি জীবনে। ঘরে থাকা প্রগতি আর মামুলি নিউজ পেপারে লেটার প্রিন্টে ছাপানো শরৎচন্দ্র। আশির দশকে মধ্যবিত্তের ঘরে দুই ব্যান্ডের রেডিওর মতোই আবশ্যিক অনুষঙ্গ। বইগুলো শুনেছিলাম বাবা মায়ের বিয়ের উপহার। সাথে এসে জুটলো উদয়ন, নারী আর উভচর মানুষ। মাক্সিম গোর্কির মা, পৃথিবীর পাঠশালাও উত্তরাধিকারে ঘরেই পেয়েছি। তখন তলিয়ে ভাবিনি। এখন ভাবি এক ক্ষয়িষ্ণু দরিদ্র ঘরে,জীবন সংগ্রামে পর্যদুস্ত একটি পরিবারে বইগুলো কিভাবে এসেছিলো, কে এনেছিলো, কেন এনেছিলো, কে পড়েছিলো? উত্তরাধিকারে বইগুলো এখন আমার একমাত্র সম্পদ। আমাকে এই পার্থিব তুচ্ছাতিতুচ্ছ বেদনা, উত্তরাধিকার সূত্রে যা এখন আমার অমূল্য সম্পদ।

কী করে সেই পুতুল খেলার বয়সে আমার ভালোলাগার বই মন্দলাগার বই আমার কাছে ঠিক কবে থেকে রেললাইনের মতো সমান্তরাল ধারায় বিভক্ত হয়ে গেলো আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি। তবে সেই স্কুলের বাউণ্ডারি না পেরোনো বয়সে আমি যখন পথের পাঁচালি কিংবা কবি পড়ছি, দেখছি দু চারজন পড়ুয়া সহপাঠী মাসুদ রানা সিরিজে বুঁদ। না ভুল ব্যাখ্যা করবেন না। মাসুদ রানা সিরিজকে অবমূল্যায়ন বা মন্দ বই আখ্যায়িত করছি না, বলেছি ভালোলাগা কিংবা মন্দলাগার বই। এবং তা একান্তই ব্যক্তি আমার।

শহরের একটি মাত্র লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি তখন শহরের ঠিক মাঝখানে। পাশেই টাউনহল। টিনের চালা আর কাঠের বেঞ্চি। সেখান থেকে ভেসে আসে "আমি যার নূপুরের ছন্দ...." নিক্কনধ্বনি। কখনোবা " আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো..." হারমোনিয়ামের রিডে মনকাড়া কিন্নরী। তখনও এই শহরে গলি পার হতে হতে গানের রেওয়াজ আর পড়া মুখস্থ করার উচ্চকিত প্রতিযোগিতা শোনা যেতো। স্কুল থেকে যাওয়া আসার পথে আমি গন্তব্য ভুলে দাঁড়িয়ে পরতাম লাইব্রেরির সামনে। ভেতরে বড় বড় কালো কুচকুচে প্রাগৈতিহাসিক কালের সাক্ষী টেবিল, হাতল ওয়ালা নকশি চেয়ার। ভেতরে গোটা কয়জন মানুষ। কারো সামনে বই নেই, কেবলই পত্রিকা। সারি সারি বইয়ের রেক, যেনো অথৈ সমুদ্রের আহবান...।

বাবার কাছে বায়না ধরলাম, বাবা আমাকে কার্ড করে দাও। কখনো জেনেছিলাম এই লাইব্রেরিতে যেতে কার্ড লাগে। বাবা একদিন শক্ত লাল কার্ডে দোয়াতের কালি ঢুকানো কলমে লেখা একটা কার্ড করেও দিলেন। জানলাম মেয়ে বলে আমার প্রতিদিন যাবার অনুমতি নেই। সপ্তাহে একদিন। খুব অস্বাভাবিক লাগেনি সে বয়সে শুনতে। এখন অবাক হয়ে ভাবি, একটা মেয়ে সপ্তাহে একবার বইয়ের জন্য লাইব্রেরিতে যাওয়ার নিয়ম, এ আর কী এমন বেখাপ্পা! জন্ম থেকেই মেয়েদের জন্য নির্ধারিত এসব নিয়মনীতি, বিধি নিষেধ দেখতে দেখতে এর বিপরীতে কোনো সত্য থাকতে পারে, এবং এই চাপিয়ে দেয়া নিয়মই যে চরম অনিয়ম, এরকম ভাবনার দুয়ার খোলার তো কোনো অবকাশই হয়নি তখনও।

সেই বিকেলটা,কী বার এখন ঠিক মনে পড়েনা। শনিবার হবে খুব সম্ভব, হাফ স্কুল, হাফ অফিস। বাবা নিয়ে যেতো হেঁটে হেঁটে, আকাশ ঢেকে আসা সন্ধ্যার ছায়ায়, টুং টাং দুয়েকটা রিক্সা চলে যেত পাশ ঘেঁষে। শহরের বাতাসে গভীর নলকূপের ঠাণ্ডা জলের মতো তৃপ্তি। মাটির মেঝেতে কাঠের রেকে সারি সারি পণ্য সাজানো দোকান,রাস্তার পাশে ক্যারাম খেলায় মগ্ন তারুণ্য সব পেরিয়ে আমি পৌঁছে যেতাম পাবলিক লাইব্রেরিতে। সামনে একটা শিউলি গাছ। নিকানো তলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলে বোধ হতো এক অজানা মহাদেশে ঢুকে গেছি। সেখানে আরো শীতলতা, ঠাণ্ডা,জাগতিক অস্থিরতার সাধ্য কী এই হিম স্থিতধী মূহুর্তকে স্পর্শ করে! এর পথে পথে, অলিতে গলিতে, পাতায় পাতায় কতো মানুষ কতো গল্প না জানা কাহিনী। না জানা আখ্যানে হাসা, কাঁদা, গল্পের বাঁকে চোখের জল ফেলতে ফেলতে হেসে ওঠা। অচেনা কতো পাড়া মহল্লা গ্রামের কতোরকম মানুষের আপন হয়ে ওঠা।

"মানুষ কি চায় — উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে?”(আরণ্যক)। পাগমান শহরের শবনম, কবির ঠাকুরঝি-জীবন এতো ছোট্ট কেনে, হোসেন মাঝির -মিয়া কতো ঘুমাইবা কত জীবন যে দেখা, কতো মানুষ যে চেনা, সেই চেনার পথ ধরে বিষবৃক্ষ কিংবা চোখের বালি, রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টারের সাথে পরিচয়। লম্বা এ তালিকা এখনো বহমান।

আর পুরানো সেই বইয়ের পাতায় চুপ করে ঘাপটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা এক অনির্বচনীয় গন্ধ। মোটা মোটা বইয়ের নিউজপ্রিন্ট পাতার গুটি গুটি অক্ষরগুলো কি অসীম যত্নে জমিয়ে রাখতো সে ঘ্রাণ। আখ্যানের চেয়ে কম আকর্ষণীয় ছিলো না সেই ঘ্রাণ। গল্পে ডুবার আগে পাতার পর পাতা উল্টে ঘ্রাণ নিতাম শুধু। আহা! সেই ঘ্রাণ সেই যে নিয়েছিলাম প্রানভরে। আজো চোখ বন্ধ করে যেমন দেখতে পাই কাশবন পেরিয়ে রেললাইন, ময়নার দ্বীপ, সোনাবাবুর গাছ, ঠিক তেমনই ডুবে যেতে পারি সেই ঘ্রাণে।

আমি জানিনা বই পড়ুয়া কজন সেই ঘ্রাণের সন্ধান পেয়েছে, পড়ার উপর যা বিশেষ বাড়তি পাওনা! যা আমার আছে, আমি পেয়েছি। যার তুল্য নয় পৃথিবীর কোনো ঘ্রাণ। এ আমার স্বপ্নরাজ্যের ঘ্রাণ, এ আমার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নরাজ্য। বুঝি এখানে এই গন্ধে মিশেই, এই বইরাজ্যের একটি পৃষ্ঠা হয়েই থেকে যেতে চাই আমি।

জীবনের উত্থান পতনে একসময় তার সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছে আমার। সময়ের স্রোত বেয়ে সেই লাইব্রেরিটি স্থানান্তরিত হয়েছে। সুরবিতান ললিতকলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনে। দুয়েকদিন গিয়েছিলাম সেখানে। পুরানো দুর্লভ সেই বইগুলো নেই। ঝা চকচকে মলাটের সমসাময়িক কেজো অকেজো বইয়ে বেশ সেজেছে লাইব্রেরিখানা। কিছু আসল, কিছু পাইরেসি। পুরানো দুর্লভ বই সব উধাও। নতুন লাইব্রেরিয়ান ঠিক জানেনা কোথায় আছে সেসব। ঘুরে ঘুরে দেখি কাচা কাঠে রং করা টেবিল আর বইয়ের রেক। সবকয়টা চেয়ার খালি, সুনসান। নতুন বিল্ডিং আর নতুন ফার্নিচারে সাজানো লাইব্রেরিটি দেখে আমার কেবল রবিবুড়োকে মনে পড়ছিল, "ছিলে রাণী হলে দাসী"।

আর আমার সেই স্বপ্নরাজ্য আমাকে গড়ে তোলা লাইব্রেরিটি এখন একটি রেস্তোরা। বারান্দায় যেখানে শিউলি হাসনাহেনা ছায়া ফেলতো সেখানে সারি সারি ডালপুরি, পিঁয়াজু। ভেতরে মুরগির নাড়িভুঁড়ি স্তুপ করা। টেবিলে টেবিলে উঠতি তরুণদের হাতে হাতে স্মার্টফোন, তাদের হুল্লোড় জানেনা এখানে একদিন পিনপতন স্তব্ধতায় কতো পড়ুয়া ডুবে যেতো অচেনা ভুবনে। টেবিলের পলিথিনে এঁটোকাঁটার পাহাড়। রসুন-পেঁয়াজের ঝাঁঝালো গন্ধ। দেয়ালে বড় বড় আয়নার সামনে হাত ধোয়ার সাবান আর সারি সারি বেসিন। এগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি ঠিক কোথায় ছিলো সোনাবাবু, রামের সুমতির রাম, নষ্টনীড়ের চারু, নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজের সোনাবাবু....।

বের হতে হতে নাকে ধাক্কা দেয় উচ্ছিষ্ট আবর্জনার দুর্গন্ধ। নাকে কাপড় চেপে বের হতে হতে উপরে তাকাই। একদা গ্রন্থাগারের সাক্ষর নিয়ে বিল্ডিংয়ের ছাদে একটি প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের ভাস্কর্য। নানা আগাছায় ঢাকা,ক্ষয়ে গেছে ইট সিমেন্ট।

আমাদের পাঠের অভ্যাসহীন প্রজন্মের মেটাফর বুঝি।

পড়ুয়া is a reader-supported publication. To receive new posts and support my work, consider becoming a free or paid subscriber.

Share this post

ছিলে রাণী হলে দাসী

www.porua.net
Share
Previous
Next
Comments
Top
New
Community

No posts

Ready for more?

© 2023 Riton Khan
Privacy ∙ Terms ∙ Collection notice
Start WritingGet the app
Substack is the home for great writing