বাৎসরিক ডাইনোম্যানিয়া
দেবজ্যোতি পাল | প্রিয় বন্ধু সদ্য বইমেলা থেকে ফিরেছে। কি বই কিনলি রে। দেখি একটা চওড়া ডাইনোর বই বাগিয়েছে। ডাইনোসরাসের ফসিল নিয়ে প্রচুর ছবি ও প্রচুর লেখা সমৃদ্ধ একটা বই। গরমের ছুটির দুপুরে পড়ার জন্য চেয়ে
দাদু ডাইনোসর কি? সকাল সকাল সংবাদ পত্রে খুলির ছবি আঁকা একটা পোস্টারেরে তলায় শব্দটা পেয়েছি। তারপর থেকেই মাথায় ঘুরছে সেটা কি ও কাকে বলে। ঘুম পাড়াতে পাড়াতে দাদু গানের সুরে বললেন প্রাগৈতিহাসিক কালে কিছু ভীষণ বড় বড় জন্তু আমাদের পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়াত বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছে ডাইনোসর। তখন প্রাগৈতিহাসিক এবং বিশাল এই টুকুই মাথায় জমা পড়ল। কয়েকদিন বাদে টিভিতে দেখলাম একটা পার্ক ভেঙে পড়ছে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপে দাপাচ্ছে করাল দংষ্ট্রা। সিনেমা হলে দেখে যারপরনাই ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ের সাথে সাথে কৌতূহল জেগে উঠল এই যে মাংসাশী প্রাণী দেখাচ্ছে তাদের উৎপত্তি কোথা থেকে আর তারা হারিয়ে গেল কোথায়? খোঁজ চলতে লাগল। কিছু বছর পর হাতে এলো একটা আনন্দমেলার সংখ্যা। টুকরো তথ্য পড়ে জানলাম ডাইনোসর হচ্ছে পাখীর পূর্ব পুরুষ। তৃণভোজী ও মাংসাশী এই দুই ভাগে তাদের ভাগ করা চলে। আরো কিছু শব্দ পেলাম ক্রিটেসিয়াস জুরাসিক ট্রায়াসিক। শব্দ গুলো তখন বুঝলাম না কিন্তু মনে গেঁথে গেলো। সময় একটু একটু করে কাটছে। একা একা ডাইনোসর নিয়ে খুব বেশী তথ্য জোগাড় করতে পারছি না। ক্লাসে এক বন্ধুর মুখে শুনলাম ভয়ানক এক উল্কাপাতের ফলে এই সমস্ত প্রজাতিটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিছুদিন বাদে আনন্দমেলার কোহিনূর প্রচ্ছদ সংখ্যার সাথে ছোট্ট একটা ডাইনোসরের বই উপহার পেলাম। টিরানোসরাস ব্রঙ্কিওসরাস ইত্যদি নাম উচ্চতা কি খায় কোথায় ঘোরে টুকরো তথ্য পেলাম। তৃষিতের মতো বারবার সেই ছোট্ট বইটা পড়ে প্রায় লুচি ভাজা বানিয়ে ফেললাম। তখন ডাইনো সম্বন্ধে জানার ডাইনো সদৃশ অনুসন্ধিৎসা তৈরি হচ্ছে অনুপস্থিত খালি খাবার।
প্রিয় বন্ধু সদ্য বইমেলা থেকে ফিরেছে। কি বই কিনলি রে। দেখি একটা চওড়া ডাইনোর বই বাগিয়েছে। ডাইনোসরাসের ফসিল নিয়ে প্রচুর ছবি ও প্রচুর লেখা সমৃদ্ধ একটা বই। গরমের ছুটির দুপুরে পড়ার জন্য চেয়ে নিলাম। ছবি দেখে দিব্যি লাগছে ছবির তলার লেখা কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আরো কয়েকদিন ছবি দেখে বন্ধু কে ফিরিয়ে দিয়ে এলাম সেই বই। বন্ধুর সাথে এক বিকেলে স্টেশনের ধারে ঘুরছি। দুজনের পকেট হাতড়ে কিনে ফেললাম কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান। পড়ুয়া বন্ধু রাস্তাতে উল্টে পাল্টে গিয়ে থামল একটা ধারাবাহিক লেখায়। পঞ্চ মৃত্যুর দ্বীপ। অনুবাদক অদ্রীশ বর্ধন। বন্ধু বলল আরে এটা মাইকেল ক্রীকটনের দা লস্ট ওয়ার্ল্ড অনুবাদ করেছে। জানিস লস্ট ওয়ার্ল্ড নাম দিয়ে আর্থার কনান ডয়েল ও একটা বই লিখেছিলেন। আমার কাছে আছে নিয়ে পড়ে দেখিস। ঝুলি ভর্তি কি ওয়ার্ড জমা পড়ল। পঞ্চ মৃত্যুর দ্বীপ ধারাবাহিক চলছে। ধারাবাহিক উপন্যাসে আরেকটা তথ্য পেলাম এর আগের উপন্যাসের নাম মেঘ দ্বীপের আতঙ্ক। বন্ধু তথ্য জুড়ল ওটা জুরাসিক পার্কের অনুবাদ। জুরাসিক জুরাসিক প্রাগৈতিহাসিক ছোটবেলায় শোনা সেই রহস্যময় শব্দ। না এই বইটা ছাড়া যাবে না পড়তে ই হবে।
সে বছর বইমেলা গেছি। অন্যান্য বই কিনে টাকা পয়সা প্রায় শেষ। এক স্টলে উকি দিচ্ছে করাল দংষ্ট্রার ছবি সহ পঞ্চমৃত্যুর দ্বীপ। এমারজেন্সি পয়সা দিয়ে দুম করে কিনে ফেললাম সে বই। বাড়ি ফিরে কানমোলা জোটে জুটুক ও বই মোটেই ছাড়া যাবে না। কোস্টারিকা দ্বীপ পুঞ্জের মধ্যে ছোট্ট দ্বীপ আইস্লা সোরনা দ্বীপে ঘটা অমন জমজমাট এডভেঞ্চার আমি তো পড়লাম বাবাকেও সে বইয়ের নেশা ধরিয়ে দিলাম। ছুটির দিনের উত্তম সুচিত্রা ডুয়েট সরিয়ে রেখে তিনি বইটা শেষ করতে মেতে গেলেন।
এইবার একটু একটু করে বড় হওয়ার পালা। ইঞ্জিনিয়ার বনার পালা চলছে। ট্রেনিং করতে দৌড়েছি বাঁকুড়া। বাঁকুড়া শহর থেকে ডি ভি সি পাওয়ার প্ল্যান্টে পৌঁছানর রাস্তার দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। কলকাতার বাসরাস্তা নয় মোটেই সে রাস্তা। বরং ভাঙাচোরা জনপদ ছাড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগিয়ে দেয় প্রায় ঘণ্টা তিনেক। ফেরার
সময় ও তাই। উপরি পাওনা বিকেল চারটের মধ্যে বেরোতে না পারলে শেষ বাস মিস হয়ে যাবে তখন গোটা রাত বাঁকুড়ার জঙ্গলে রামা হো রামা হো গেয়ে কাটাতে হবে। বাকুড়ায় শীতটাও পড়ত জব্বর। শহুরে বাঙ্গালীকে কুঁকড়ে জবুথুবু করে দিত। দিন দুয়েক জার্নি করে রাতে ঠাণ্ডায় কেঁপে সারা শরীরে ভীষণ বেদনা গজাল। দুই বন্ধুতে শলা পরামর্শ করে ঠিক হলো আজকের দিন আমরা ছুটি নেব। বাজারের পাণ্ডেজির হোটেল থেকে ঘন অড়হরের ডাল রুটি সব্জি খেয়ে ফিরে এসে দুপুর দুপুর বেমক্কা অবসর জুটে গেল। অবসরে বন্ধুর ব্যাগ হাতড়ে এক কপি জুরাসিক পার্ক বেরোল। দুপুর থেকে পড়া শুরু করে এইসান মজে গেলাম পরের দিন ও ট্রেনিং কে ছুটি দিয়ে দেওয়া হল। জুরাসিক পার্কের অপারেটিং সিস্টেম পড়ছি প্রকৃতি পরিবেশ পড়ছি মনে মনে ছবি আঁকছি। পরের দিন আবার প্লানটে বেরিয়ে পড়া হল। ভেতরের হাঁটা রাস্তায় আগের দিনের পড়া জুরাসিক পার্কের গন্ধ বর্ণনা সব খুঁজে পাচ্ছি। পাশে সরিয়ে রাখা ভাঙা ট্রান্সফরমার কে ভেবে নিলাম টিরানসরাস রেক্স।
বয়স বাড়তে লাগল পাগলামি ও সেই সাথে বাড়তে লাগল। বই পড়ার বুভুক্ষ খিদে পাকাপাকি কলকাতার বাসিন্দা বানিয়ে দিলো। ফুটপাথ ঘেঁটে একে একে জুটিয়ে ফেললাম জুরাসিক পার্ক দা লস্ট ওয়ার্ল্ড। এবং অধুনালুপ্ত ফ্যান্টাস্টিক প্রকাশনীর মেঘ দ্বীপের আতংক। চওড়া বইতে সেই ছোটবেলার দেখা খুলি আঁকা। পাগলামি ঘনানোর সাথে সাথে জেঁকে বসল বাৎসরিক ডাইনোম্যানিয়া। বছরে একবার করে জাগবে জেনে নেব নতুন কিছু তথ্য। তথ্য জানতে গিয়ে আম্রিকান পপ কালচারের একটা বই হাতে এলো।
From Walden Pond to Jurassic park. পড়তে গিয়ে জানতে পারলাম Walden বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এক ট্রাভেলগ। লেখক walden জঙ্গলে বছরে একবার নির্বাসনে যান গিয়ে আরণ্যকের মতো সাহিত্য সৃষ্টি করেন। সে বই ও ফুটপাথের কল্যাণে জোগাড় হয়ে গেল।
ডাইনো ম্যানিয়া তে মাততে গিয়েই জানলাম ডাইনোর গোটা ফসিল আবিষ্কার নিয়ে দুই বিজ্ঞানীর ধুন্দুমার কাণ্ডকারখানা। বইখানার নাম The dragon teeth. ডাইনো ঘাটতে গিয়ে ই এক মজাদার সাহেবের নাম পেলাম Stephen Jay Gould। বর্তমান ম্যানিয়ার বশবর্তী হয়ে আরেকখানা বইয়ের খোঁজ পেয়েছি, যাতে শেখায় ফসিল থেকে গোটা ডাইনোসরে কি আদৌ ফেরা যায়? ফেরা গেলে কী তার গতিবিধি। সেই বই নিয়ে ই আপতত মেতে আছি।