দোস্ত-এর জন্য বই
আশফাক স্বপন | হয়তো আমি সেকেলে মানুষ, কিন্তু মার্কিন দেশে বাচ্চাদের বই দেখে আমার মন ভরে না। আমার ছোটবেলায় ইংরেজি বইয়ের সম্ভারে ধ্রুপদী সাহিত্যের যে শিশুতোষ রূপ দেখতাম, সেটা এদেশে কম দেখি বলে মনে হয়।
১। দোস্তকে ছোট্ট ইশতেহার
(দোস্ত মানে তাহান। তাহান খান। আমাদের রিটনের সুপুত্র। কয়েক বছরের পরিচয়ে আমার বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে। এই ১৬ ডিসেম্বর ও আট বছরে পা দিল। )
দোস্ত, বড্ড তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যাচ্ছ! এই তো ক'বছর আগেও কেমন জড়িয়ে ধরে hug দিতে। এখন তোমার এমন মুরুব্বিয়ানা চাল হয়েছে যে এসব আদিখ্যেতার কথা ভাবাই যায় না। তোমার বাবার কাছে শুনি দিনে দিনে বড়োদের কাণ্ডজ্ঞান সম্বন্ধে তোমার সংশয় বেড়েই চলেছে।
Pandemic-এ হয়েছে আরেক যন্ত্রণা। তোমার সাথে দেখা-সাক্ষাতের উপায় নেই। তাই নিজে হাতে বইগুলো তোমার হাতে দিতে পারলাম না। তবে Facetime-এ তোমার সাথে কথা বলে মনটা ভরে গেল। কী সুন্দর বাংলা বলা শিখছ!
আশা করি বইগুলো তোমার ভালো লাগবে। কোনোবই হয়তো একটু ভারি, কোনোটার ভাষা কঠিন। কঠিন লাগলে বাবাকে বলো, বুঝিয়ে দেবে। তবে সব বইয়ে ছবিগুলো কিন্তু খুব সুন্দর, তাই না? এই যে আমার এতো বয়স হয়েছে, আমিই তো ছবিগুলো দেখে দেখে চোখ ফেরাতে পারিনা, মন যেন কোন অজানা জগতে চলে যায়, আর ফিরতে চায় না।
তোমার জীবনটা সুন্দর হোক। কামনা করি তুমি বড় হয়ে বাবার থেকেও বেশি বই-পাগল হও। এর চাইতে বড়ো আশীর্বাদ আমার জানা নেই। অনেক অনেক আদর নিও।
২। কী দিলাম, কেন দিলাম
হয়তো আমি সেকেলে মানুষ, কিন্তু মার্কিন দেশে বাচ্চাদের বই দেখে আমার মন ভরে না। আমার ছোটবেলায় ইংরেজি বইয়ের সম্ভারে ধ্রুপদী সাহিত্যের যে শিশুতোষ রূপ দেখতাম, সেটা এদেশে কম দেখি বলে মনে হয়। যে রূপকথার বই আমার বাল্যকালকে আলোকিত করেছিল, সেটা যে এখানে নেই, তা নয় – তবে সেটা যে রূপ নিয়েছে সেটা আমার তেমন পছন্দ নয়। এই ব্যাপারে নাটের গুরু হলো Disney. এমন সর্বপ্লাবী তাদের ক্ষমতা, যে একবার একটা ছবি বের হলো কী তার সাথে খেলনা, পুতুল, বই সব কিছু বেরোয় আর দেদারসে বিকোয়। অত্যন্ত চোখধাঁধানো বই, কিন্তু কোথায় যেন একটা ফাঁকি রয়েছে। 3D CGI, কম্পিউটার গ্র্যাফিক্সের বুজরুকিতে সৃষ্টিশীল মানবিক সৌকুমার্য যেন ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। আমার তো মনে হয় সামগ্রিকভাবেও Disney সম্বন্ধে এই কথা খাটে। যেমন আজকের blockbuster বাচ্চাদের ছবির তুলনায় আমার কাছে অনেক অনেক আকর্ষণীয় গত শতাব্দীর মাঝামাঝি ওদের প্রথম দিককার animation-এর কাজ – যেমন Fantasia বা Snow White and the Seven Dwarfs.
মুশকিল হয়েছে কী, একবার ডিজনির কোন ছবি বেরোলে আর রক্ষা নাই। আর সব জায়গার মতো বইয়ের বাজারেও সিন্দবাদের দৈত্যের মতো ওদের বই চেপে বসে, তাছাডা backlist তো আছেই। আজকের multimedia যুগে cross-platform-এর প্রভাব খুব বেশি - যেই বাচ্চা Toy Story কি Aladdin দেখছে, সে বাবা-মায়ের সাথে বইয়ের দোকানে গেলে পরিচিত গল্প আর চরিত্রের বই খুঁজবে।
আমাদের ছেলেবেলায় তো এসব ছিলনা, তখন বড় বড় ইংরেজি প্রকাশকদের বইয়ে হাতে আঁকা অপূর্ব সব চিত্রায়ণ ছিল, আর বহুদিনের যে গল্প কাহিনীর পরম্পরা, সেসব থেকেই বাচ্চাদের রূপকথার বই হতো। Grimms fairy tales আর বিশেষ করে Hans Andersen-এর জাদুকরী গল্পের কথা আজও ভুলতে পারিনা।
এদেশে বাচ্চাদের ভালো বই যে নেই তা নয়, তবে খুঁজে বের করতে হয়। Marvel আর DC-এর মারদাঙ্গা superhero আর Disney-এর 3D computer graphics-এর ভীড়ে হাতে-আঁকা ছবি আর ধ্রুপদী গল্পের বই বের করা অনেকটা কচুরীপানায় ঠাসা পুষ্করিণীতে পদ্মফুল খোঁজার মতো। তবে খোঁজেও একটা আনন্দ আছে।
সুন্দর বই যদি বা খুঁজেপেতে পাই, আগুন দাম। সাধ অনেক, সাধ্য সীমিত। তাই বেছে বেছে এই তিনটা বই কিনলাম দোস্তের জন্য।
I Talk Like a River
By Jordan Scott. Illustrated by Sydney Smith
40 pp. Holiday House.
বাচ্চারা খুব visual. আমি নিজে অন্তত তো তাই ছিলাম। তার ওপর আজকাল হয়েছে multimedia-এর যুগ। বাচ্চারা মায়ের পেট থেক পড়েই gadget নিয়ে খেলতে শেখে। সেই জন্য বিশেষ করে এই বইটা বাছলাম। বইটার শব্দসংখ্যা এত কম, এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়। কিন্তু বইটির আসল সম্পদ তার ছবি। আহ, কী সুন্দর যে অলঙ্করণ। হাতে আঁকা পাতার পর পাতা চিত্রায়ণ impressionist চিত্রশিল্পীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। (ছবি দেখুন) সেই ছবিগুলো প্রত্যেকটা সত্যি হাজার শব্দের চাইতে বেশি, তার দিকে তাকালে কল্পনার ফানুস যে কোথায় চলে যায়! সাধে কী আর বইটি এই বছরে New York Times-এর বাচ্চাদের বইয়ের অন্যতম সেরা বাছাই?
The Illustrated Treasury of Classic Children’s Stories.
By Charles Santore
552 pp. Applesauce Press.
আমি যখন ছোট ছিলাম, রূপকথা বলতে অজ্ঞান ছিলাম। রাজা-রাণী, রাজপুত্র-রাজকন্যা, রাক্ষস, পেত্নী, পরী,অদ্ভুত জীব-জন্তুর মোহময় রূপকথার জগত আমাকে চুম্বকের মতো টানতো। আর হ্যা, গল্পের বইয়ে ভালো ছবি চাইই চাই। শুধু ছাপা অক্ষর দেখতে কার ভালো লাগে? তবে আজকাল কিছু বইয়ে যে খুব stylized অঙ্কন দেখা যায়, তা নয়। নিখুঁত রঙিন, realistic ছবি, যাতে গল্পের কোন মুহূর্ত জীবন্ত হয়ে উঠবে, সেটা কল্পনাকে উষ্কে দেবে, তবেই না রূপকথার বই পড়ার মজা।
এই বইয়ের লেখক খুব নামকরা শিশুতোষ বইয়ের আঁকিয়ে। বইটিতে Wizard of Oz, Peter Rabbit, Little Mermaid, Alice in Wonderland-সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় পাশ্চাত্যের গল্প, ছোটদের মনোরঞ্জনের জন্য ছোটদের মতো করে লেখা। আর সেই সাথে প্রতিটি গল্পের মেজাজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অপূর্ব সব ছবি। কোন রকম যান্ত্রিক ফাঁকি নেই, একেবারেই হাতে আঁকা, তার জাদুই আলাদা। (ছবি দেখুন)
Knowledge Encyclopedia’s Animal!
By John Woodward
288 pp. DK (in association with Smithsonian Museum)
বাচ্চাদের শুধু গল্পের বই পড়লে কি চলে? আমাদের চারপাশের বিচিত্র জগৎ সম্বন্ধেও তো জানতে হবে, তাই না? এই যে আমাদের চারপাশে পৃথিবী, জীবজন্তু, প্রকৃতি, মহাবিশ্ব – এই সম্বন্ধে একটা বিস্ময়বোধ, একটা মমতাপূর্ণ আত্মীয়তাবোধ গড়ে তোলার এই তো সময়। তবে সেজন্য সেরকম বই চাই।
এই বইটির ক্ষেত্রে আমি নিজস্ব প্রথা ভঙ্গ করেছি, এক্ষেত্রে computer graphics-এর ফল এমন চোখ ধাঁধানো যে আমার কাছে তার সাত খুন মাফ। বিশাল দুই-পাতা জুড়ে একেকটা প্রাণীর double-spread, সে এমনই নিখুঁত যে মনে হয় এই বুঝি বইয়ের পাতা থেকে বাস্তবে উঠে আসলো। (ছবি দেখুন) সমগ্র বইটিতে প্রাণীজগতের বিচিত্র বর্ণাঢ্য রূপ নতুন করে প্রকৃতির প্রতি বিস্ময় আর সম্ভ্রম জাগায়। সেই সাথে প্রাণীজগৎ সম্বন্ধে অজস্র তথ্যে বইটি ঠাসা, পাঠকের জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে।
৩। বইপড়া আর আমার বাল্যকাল
পাঁচ বছর বয়সে যখন আমার সাক্ষরতা হয়, তখন আমি bilingual। ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই আমি স্বচ্ছন্দ। সুতরাং ছোটবেলা থেকে একই সাথে বাংলা ও ইংরেজী দুই ভাষার বইয়ের সাহচর্যে বড় হয়ে উঠেছি।
যখন একদম ছোট ছিলাম তখন পূর্ব পাকিস্তান আমল। ছোটদের বইয়ের প্রকাশনায় পূর্ববঙ্গ মোটেও পশ্চিমবঙ্গের মতো অত সমৃদ্ধ ছিলনা। তারপরও কিছু কিছু বইয়ের মধুর স্মৃতি ভোলার নয়। যেমন মধ্য এশিয়ার লোকায়ত রসিক চরিত্র নাসিরুদ্দীন হোজ্জাকে নিয়ে প্রাণেশ মণ্ডলের অপূর্ব অলঙ্করণে মোহাম্মদ নাসির আলীর 'ভিনদেশী এক বীরবল'। ছোটদের জন্য চমতকার লিখতেন এখলাসউদ্দীন আহমদ। তার 'টাপুর টুপুর' নামে বাচ্চাদের একটা চমৎকার কাগজ ছিল।
১৯৬৫-এর যুদ্ধের পর ভারতের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্নহয়ে গেল – তারপরও চোরাপথে মাঝে মাঝে দেব সাহিত্য কুটির-এর শারদীয় সঙ্কলন আসত, সেসব বই হাতে পাওয়া মানে হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়া। যেমন তার অলঙ্করণ (আমার বিশেষ প্রিয় ছিল নারায়ণ দেবনাথের নিপুণ স্কেচ), তেমন তার গল্প। বড়ো হবার পর বুঝলাম – পশ্চিমবঙ্গের বড়োদের লেখকরা প্রায় সবাই ছোটদের জন্যও লেখেন। দেব সাহিত্য কুটিরের সঙ্কলনে প্রেমেন্দ্র মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, এমনকি বুদ্ধদেব বসুর লেখাও পড়েছি (যতদূর মনে পড়ে বুদ্ধদেবের বসুর 'বড্ড বেশি গান' বলে একটা রম্যরচনা পড়েছিলাম। খুব অবাক হয়েছিলাম, এত বড় কবি, সাহিত্যের পণ্ডিত, আবার বাচ্চাদের জন্য লেখেন?)
একাত্তরে স্বাধীনতার পর অবস্থা অনেক বদলে গেল। এই প্রথম হাতে পেলাম সত্যজিৎ রায়ের বই। তখনও আমার অল্প বয়স – অবাক হয়ে গেলাম। একই লোক বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার, সেই-ই আবার ছবি আঁকে, ছোটদের জন্য এত সুন্দর করে লেখে!
ঐ সময় আমাদের দেশে এক বিশাল, বিশাল প্রাপ্তি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর বই। একেবারে ছোটদের জন্য ছিল বিশাল মাপের পাতলা গল্পের বই। যেমন গল্প, তেমন তার অপূর্ব অলঙ্করণ। সেখানে লেভ তলস্তয় থেকে শুরু করে ভাসিলিসার রূপকথা, হাল্কা, হাস্যরসাত্মক বই অজস্র বাঙালি ছেলেমেয়েদের মনোরঞ্জন করেছে। ননী ভৌমিকের অনুবাদ তরতর করে পড়তাম, একটিবার মনে হতোনা গল্পগুলো ভিন ভাষায় রচিত হয়েছিল। আরেকটা জিনিস নিয়ে আমি নিজে মজা পেতাম, সেটা হলো কখনো কখনো কোন কোন সোভিয়েত বইয়ের বাংলা ও ইংরেজি রূপ মিলিয়ে দেখতাম। যেমন একটা দারুণ মজার ছোটদের সোভিয়েত বই 'বাবা যখন ছোট' (ইংরেজি 'When Daddy Was a Little Boy’).
চীন থেকেও বাচ্চাদের বাংলা বই আসতো। সেগুলোও বেশ ভালো ছিল, তবে সংখ্যায় অনেক কম।
একই সাথে ছিল ইংরেজি বাচ্চাদের বইয়ের তাক লাগানো জগত। বিলেতী এক লেখক Enid Blyton যে সারা পৃথিবীতে কত কোটি কোটি বাচ্চাদের মনোরঞ্জন করেছে! ভদ্রমহিলা লিখেছেনও অজস্র বই। একেবারে ছোট্টদের জন্য বইগুলো অনেকটা রূপকথামূলক। আরেকটু বড় হলে রহস্য-রোমাঞ্চ, তবে সেটা শিশুতোষ রচনা, কোনরকম হিংসা হানাহানি নেই।
আমাদের সময়ে বাচ্চাদের ইংরেজি বইয়ে Disney, Marvel-এর এত দাপট ছিলনা। তখন ধ্রুপদী রূপকথা, আর ধ্রুপদী সাহিত্যের শিশুতোষ রূপ বেশ জনপ্রিয় ছিল। মনে পড়ে Oxford University Pressআর Macmillan Jules Verne, Charles Dickens, Robert Louis Stevenson, ইত্যাদি লেখকের ছোটদের সংস্করণ বের করতো। (অনেক সময় সেসব ইংরেজি স্কুলে পাঠ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হতো)। আমার কাছে Oxford-এর প্রকাশনা বেশি ভালো লাগত, কারণ ওই বইগুলোতে ছবি বেশি, আর গল্প সম্পূর্ণ নতুন করে, আরো সহজ করে লেখা হতো। কিন্তু বই হিসেবে সম্ভবত Macmillan-এর বই উত্তম ছিল – কারণ ওরা যতদূর সম্ভব বইয়ের বাছাই অংশ মূলানুগ রেখে ভাষা একটু সহজ করে দিত, তাতে ছোট্ট পাঠক মূল লেখকের রচনার কিঞ্চিত স্বাদ পেতো।
এছাড়া আরেকটা প্রকাশনা ছিল – Ladybird Books. সারা বইয়ে বাঁয়ের পাতায় লেখা, ডান দিকে পূর্ণ পাতার হাতে আঁকা রঙিন ছবি। এই বই আবার নানা বয়সের জন্য ভাষার নানান স্তরে লেখা।
সে এক অবাক বিস্ময়ের অপার জগত।
তারপর আস্তে আস্তে বড় হতে হতে পড়াই বই ও রূচি পাল্টাতে লাগল। ইংরেজি গল্পের বইয়ের পাঠকদের ব্যাপারে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছি যেটা বাংলা বইয়ে দেখি নি। বাংলায় ছেলে-মেয়েদের পাঠাভ্যাসে খুব একটা তফাৎ লক্ষ করিনি - সবাই কমবেশি সবধরনের বই পড়েছে।
কিন্তু ইংরেজি বইয়ের ক্ষেত্রে দেখলাম সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে উঠতে উঠতে বয়ঃসন্ধির সময় – মেয়েরা সব ঝুঁকল প্রেমের গল্প – Mills & Boon, Barbara Cartland, Denise Robins, Georgette Heyer. আর ছেলেরা যুদ্ধ আর রহস্য রোমাঞ্চ -
James Hadley Chase, Ian Fleming, Alistair McLean, John LeCarre.
সে যাই হোক, বাল্যকালের বইয়ের বিচিত্র, মনমাতানো সম্ভারই যে আমাকে বইপাগল করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।