কৃষ্ণচূড়া না থাকলে, বাড়িকে বাড়ি বলে মনে হয় না। এই ধারণা দিয়েছিল আমাদের পাড়ার সেই বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ, বাচ্চাবেলায় যাকে মনে হতো একটা বন। ওর গাছের ফল ছিল হাতে পাওয়া প্রথম বাদ্যযন্ত্র। আর প্রিয় খেলা ছিল ফুলের পরাগ দিয়ে 'ঝগড়া ঝগড়া' খেলা, যে প্রথম রেণু ফেলতে পারবে বিজয়ী হবে। কখনো ভাবতাম ভোরের সূর্যের লাল কোথায় মিলিয়ে যায়? ঐ তো কৃষ্ণচূড়ার গাছে। একবার বাংলা স্যার বলেছিলেন- কৃষ্ণ মাথায় এই ফুল পড়তেন, তাই এই নাম। অতীতের বৃন্দাবন বেয়ে কৃষ্ণচূড়া এভাবেই হয়েছিল প্রিয় থেকে প্রিয়তর, বাড়ির গাছ। দেশ ছাড়ার পর প্রথম দিকে মন খারাপ হতো এই শহরে কোন কৃষ্ণচূড়া নেই দেখে। বীজ এনে কৃষ্ণচূড়ার গাছ করব, শহরের রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া ফুটবে- 'মন পুড়ে' সময়ে এইসব স্বপ্ন দেখতাম। ষোল বছর হয়ে গেল কৃষ্ণচূড়া দেখিনি। সময় গড়ালে বুঝেছি কিছু অভাববোধ থাকতে দিতে হয়।
এখন আমার কাছে মনের মতন বাড়ি মানে কাছেপিঠে একটা লাইব্রেরি থাকবে। এ পাড়ার পাবলিক লাইব্রেরিতে প্রথম গিয়েছিলাম মেয়েকে নিয়ে, তিন মাস বয়স সবে ওর। এর আগে মেয়েকে খুব একটা বই পড়িয়েছি কি না মনে পড়ে না। ওর বাবা বলতো 'এত ছোট বাচ্চা বুঝেটা কি?' ছোটদের জন্য গল্পের আসর হয়, তাই দেখতে যাওয়া লাইব্রেরিতে। বাচ্চাদের শেকসান দেখে বিমোহিত হয়ে গেলাম। ছোট-কিশোরী টেবিল-চেয়ার, মোম রঙ, খেলনা আর কয়েক হাজার শিশুতোষ বই। সেদিন থেকে আমার মেয়ে কোনদিন না পড়ে ঘুমোতে যায়নি। তার কাছে ঘুম মানে ছিল মায়ের হাতে শুয়ে দুধের স্বাদ, মায়ের তিল ছুঁয়ে থাকা আর মায়ের হাতে ঝকঝকে কোন বই। কথা বলতে শিখে যাওয়ার পর, ঘুম পেলেই চেঁচাতো- দুদু, হাতে, তিল, বই…
গরমের ছুটি আসতে আসতে মেয়ে পাঁচ মাসে পড়লো। একদিন গিয়ে দেখি লাইব্রেরিতে হুলস্থুল চলছে এক মাসের 'সামার রিডিং ক্লাব' নিয়ে। নবজাতক থেকে সতের বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য বাবা-মায়েরা সাইন আপ করছে, রিডিং লগ নিচ্ছে। এ শহরে পাবলিক লাইব্রেরির পাঁচটি শাখা, সে বছর ২,৮৮৪ জন ছেলেমেয়ে অংশ নিয়েছিল। আমাদের পাড়ার লাইব্রেরিতে ছিল ৯৯৫ জন, সবথেকে এগিয়ে ছিলাম আমরা।
শূন্য থেকে পাঁচ বছরের বাচ্চারা ছিল প্রথম গ্রুপে। পনের মিনিট ধরে ধরে শেষ করতে হবে তিন-চারটে রাউন্ড। ইংরেজি উচ্চারণ কখনোই অত ভালো ছিল না আমার। তবুও আগ্রহ, ভেতরে সংশয়-অস্বস্তি নিয়ে পড়াতে শুরু করলাম। মেয়ে শুনতো, বই শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে যেত। বিছানা পেরিয়ে বই আমাদের সঙ্গী হতো খাবার টেবিলে, বাসে, পার্কে, দোকানে। তখনও 'ছবির বই পড়বো' বায়না করতে শেখেনি বলে আমার ভাণ্ডার থেকেও বই শুনিয়েছি অনায়াসে। এখনও মনে পড়ে- ও শুনছে আব্রাহাম লিংকনের জীবনী, অবাক হয়ে দেখছে যুদ্ধের অংশ পড়ে মা কাঁদছে অথবা মা হাসছে অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড পড়ে।
এভাবেই পনের মিনিট করতে করতে শেষ হয়ে গেল চুড়ান্ত রাউন্ডের পঞ্চাশ ঘন্টা। পরের বছরগুলোতে সময় বাড়িয়ে ১০০ ঘন্টা করা হয়েছিল। তারও পরে লাইব্রেরি ছুঁড়ে দিল আরও এক চ্যালেঞ্জ। সেই একই লাইব্রেরিয়ান একই গল্পের আসরে মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিলেন- 'এখন পর্যন্ত একমাত্র সে-ই স্কুল শুরুর আগে এক হাজার বই পড়ে শেষ করেছে।' আসলে মহামারীতে আমাদের ঘরে আটকে থাকা দিনগুলো বইয়ের পাতায় মুক্তি পেত। হাঁসফাঁস করা নিঃশ্বাস যেন খুঁজে পেত এক রঙিন কৃষ্ণচূড়া গাছ।
মেয়ের প্রথম বছরের সামার-রিডিং প্রোগ্রামের কথা মনে পড়ছে আবার। পঁচিশ ঘন্টা পড়ার পর বাচ্চারা লাইব্রেরিতে গিয়ে, রঙিন ফুলের কাগজে নিজেদের নাম লিখে কাঠ দেয়ালে লাগাত। আমিও লিখলাম মেয়ের নাম- রোদসী। নয়শ'ত ফুটফুটে রঙিন নাম, ঠিক যেন ফুলের বন। এখানে গ্রীষ্মে কৃষ্ণচূড়া ফুটে না। নাই বা ফুটুক, পড়ুয়া ফুল ফুটে থাকুক এই দুঃসময়ের শহরে।