কীভাবে বইয়ের প্রেমে পড়লাম
অভিজিৎ মণ্ডল | নীলা হোস্টেলে ফিরে গেলে আমি আবার বেরিয়ে কিনেছিলাম 'গল্পগুচ্ছ '। সারারাত চেতনে অবচেতনে সেই উষ্ণতা - যা বই ছাড়িয়ে নীলার গায়ে ছড়িয়ে থাকে তার কাল্পনিক ঘ্রাণ নিয়েছি। সারারাত ভেবে ভেবে
বই নিয়ে হৃদয় গড়া ভাঙার এক অভিজ্ঞতা আমার জীবনে একটা স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। সেই কথাই আজ বলব।
উচ্চমাধ্যমিক শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য পা রেখেছিলাম কলেজে। আর কলেজের কলজে তার হোস্টেলে রেখেছিলাম ঘুমানোর উপযুক্ত যৎকিঞ্চিত বিছানা। পরিবেশের অতর্কিত পরিবর্তন মনে যথেষ্ট অশান্তির সঞ্চার করেছিল। হোস্টেলের বেড আমার কাছে তখন হাসপাতালের কলেরা ওয়ার্ডের বেডের মতোই দুর্বিষহ ছিল। বেশিরভাগ সময়ই একটু শান্তিতে ঘুমানোর জন্য কলেজের সবথেকে নির্জন স্থান-লাইব্রেরিতে গিয়ে মাথা নত করতাম। একমাত্র এই স্থানেই ছিল তপোবনের নিস্তব্ধতা। শুধু মাঝে মাঝে বনের পাখির কূজনের মতো জোড়া নারী পুরুষের ফিসফাস শোনা যেত। বইপোকা এক দুজনের কল্যাণে প্রাচীন ঋষিদের ধ্যানমগ্নতা দেখার সৌভাগ্যও হতো। ঘুমিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলে, প্রথম প্রথম আলমারিতে রাখা বই গুলোর গন্ধ শুঁকতে যেতাম। কিন্তু গন্ধের সাথে থাকা অদৃশ্য ধুলোর কারণে অনিবার্যভাবে সশব্দ হাঁচির উদ্রেক,লাইব্রেরির নির্জনতা ভঙ্গ করে বাকিদের বিরক্তি উৎপন্ন করত। তাই তারপর থেকে প্রচ্ছদ পছন্দ হলে একটা দুটো বই নিয়ে টেবিলে এসে পাতা উল্টিয়ে দেখতাম। সেই রকমই এক পাতা ওলোট পালট করার দিনে নতুন বইয়ের গন্ধের মতো মন ভালো করা সৌরভ সাথে নিয়ে নীলা আমার সামনে এসে বসলো। আমদের প্রথম পরিচয়ের মধ্যস্থতা করেছিল আমার হাতে শুয়ে থাকা বনলতা সেন।
তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বনফুল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এলেন আমদের মাঝে যোগাযোগের সেতু হয়ে। নীলার টানেই একদিন জয় গোস্বামীর 'মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়' মুখস্থ করলাম। একরাতে পরিণীতা সমাপ্ত করলাম। আমার অবস্থা তখন রোহিণীর পিছনে পড়া গোবিন্দলালের মতো। কিন্তু নীলা 'কিনু গোয়ালার গলি' র নীলার মতোই স্থিতধী। আবেগে - আকর্ষণে স্বরবৃত্ত ছন্দের মতো দিনগুলো এগিয়ে চলছিল। তখন লাইব্রেরির প্রতি টান যতটা না বই ভালোবেসে তার থেকে অনেক বেশি নীলার সঙ্গলাভের জন্য। নীলার প্রথাগত পড়ার বিষয় ছিল আমার থেকে আলাদা এবং সে আমার থেকে এক ক্লাস উঁচুতে ছিল। তাই দুজনের ক্লাসের মাঝে একটুকরো অবসরই ছিল আমাদের লাইব্রেরির বুকের ভিতর ঢুকে বসার সুযোগ। অবশ্য ক্লাস শেষ হওয়ার পর থেকে সন্ধ্যা নামার আগে পর্যন্ত বেশ খানিকটা সময় আমারা পেতাম। জনতার ভিড়ে একসাথে পথ চলা হতো, কিন্তু আমাদের কথা গুলো কোলাহলে হারিয়ে যেত। সেরকমই এক বিকেলে নীলার আগ্রহে বইয়ের দোকান গেলাম। অনেকগুলো বই দেখে নীলা নির্বিকার মুখে 'একটু উষ্ণতার জন্য ' বইটির দাম দিল। আমার মন তখন গুলবাহার, আর অনুভূতি গুলো বুলবুলের মতো নাচছে। মনে হল 'ইচ্ছাঠাকরুণ' বোধ হয় কোনো একদিন লাইব্রেরির আশপাশ দিয়ে আমার চিত্তের দুর্বল মুহূর্তের ক্ষণে গমন করেছেন। ধরেই নিলাম এই বইটিই কালকের প্রথম ফ্রেন্ডশিপ ডে র উপহার।
নীলা হোস্টেলে ফিরে গেলে আমি আবার বেরিয়ে কিনেছিলাম 'গল্পগুচ্ছ '। সারারাত চেতনে অবচেতনে সেই উষ্ণতা - যা বই ছাড়িয়ে নীলার গায়ে ছড়িয়ে থাকে তার কাল্পনিক ঘ্রাণ নিয়েছি। সারারাত ভেবে ভেবে সকালে উঠে 'গল্পগুচ্ছে'র ভিতরে লিখেছি ভালোবাসা মেশানো কয়েকটি কথা। পরের দিন দীর্ঘতর অপেক্ষা কাটিয়ে দুপুরে নীলার সঙ্গে দেখা হলে জানতে পারলাম - সে বিশেষ কারও জন্মদিন ওই 'একটু উষ্ণতার জন্য ' বইটি দিতে বাড়ি যাবে। তারপরও আশা কিছুটা ছিল তবে নীলা ফিরে আসার পর ওই বিশেষ ব্যক্তিটির সবিশেষ পরিচয় পাওয়ার পর আমার অনুভূতিটি তখন - শশিশেখরের বিয়ের খবর শুনে যৌবনগন্ধী কঙ্কালের জীবিত শরীরের যেমন হয়েছিল ঠিক তেমনি। তবে আমি গোপনে 'খানিকটা গুঁড়া' খাওয়ার দিকে ঝুঁকিনি। তারপর বহুদিন পর্যন্ত নীলার সাথে সম্পর্ক ফিকে হয়নি, তবে ওর প্রতি আমার অনুভূতি গুলো ক্রমশ বাঁক বদলে বইয়ের দিকে ফিরেছিল। বলতে পারেন ব্যক্তি থেকে প্রেম বস্তুতে স্থিতু হলো। ওর জন্যে কেনা 'গল্পগুচ্ছ' দিয়েই যার সূচনা। তবে আজও 'একটু উষ্ণতার জন্য' বইটির প্রচ্ছদটা দেখলে বুকের সমস্ত ওম নিমিষে হিম হয়ে যায়।