

Discover more from পড়ুয়া
আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে একটা ছেলে লিলেনের নীল রঙা শার্ট পরে ভার্সিটিতে আসতো। দূর থেকে শার্টটা চোখে পড়লেই ভ্রু কুঁচকে যেতো আমার। ভাবতাম, "কী রুচি রে! অমন সুন্দর যে নীল সেই রংও এমন কটকটে হয় নাকি! নির্ঘাৎ এই ছেলে বইপত্র পড়ে না। কোনো রুচিই গড়ে ওঠেনি তাই।" আর আমি তখন তুমুল পড়ি। বুক সেলফে সেই সময়, প্রথম আলো, সবিনয় নিবেদন, দূরবীন; পড়ার টেবিলে শঙ্খনীল কারাগার, নন্দিত নরকে, কবি, উড়ুক্কু ইত্যাদি ইত্যাদি। আর বালিশের নিচে পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন, যার পাঁচ খণ্ডের পাতার ভাঁজে ভাঁজে অখণ্ড প্রেম। বই…বই…আর ময়ূর পেখমের বুকমার্ক-এই করে করে একেবারে নিবিষ্ট পড়ুয়া। কিছুটা উন্নাসিকও। ভাবতাম, শুভংকর ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে নেই, নন্দিনী ছাড়া কিছু হতে নেই। বিশ্বাস করতাম, শুভংকরের মতো চোখ পেলে আমি ‘এই পৃথিবীর সূর্যস্পন্দনের গতি বদলে দিয়ে প্রখর রৌদ্রের প্রশাসনকে তুড়ি মেরে যখন তখন গড়ে তুলতে পারতাম অমল ধবল এক জ্যোৎস্নার বাদশাহী তাঁবু।’
কী যে হলো, শুভংকরের প্রেমে ডুবতে ডুবতে একদিন সেই ছেলেটিকে রোকেয়া হলের সামনে দাঁড়াতে বললাম। সেদিন সকাল সকাল যখন বাসা থেকে বের হচ্ছি তখন একবার ভেবেছি, 'ইস, আজ না সে আবার ঐ বিচ্ছিরি শার্টটাই পরে আসে! এসেই দেখুক, একদম উল্টো হাঁটবো! পিছন পিছন ঘুরছে তাই, নইলে...!'
যাই হোক বাসা থেকে বেরিয়ে, প্রিয় 'আনন্দ' বাসে চড়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে ছুটছি...ছুটছি। ছুটছি নয়তো যেন উড়ছি। দুই বাহুতে সফেদ ডানা, মনে মনে, রোমে রোমে চাপা ভয় আর শংকা। কপাল, কপোলের আদুল চামড়াতেও ক্ষণে ক্ষণে শিরশির করে উঠছে। কী বলবো, কী করবো আজ?
লাইব্রেরির সামনে বাস থামলো শেষে। মনে হলো অন্যদিনের চেয়ে সবখানে বড্ড বেশি কোলাহল, আর সকলেই যেন আমার গন্তব্যের খোঁজ জানে তাই আড়চোখে আমাকে দেখছে। কী হবে, কী হবে ছটফটানিতে কোনোরকমে সবাইকে লুকিয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, সেই নীল শার্ট! এরপর আর কিসের ওড়াউড়ি! মাটিতে পা আর মেজাজ সপ্তম আসমানে চড়লো আমার। 'আনন্দ' বাস থেকে নিরানন্দ বেগে নেমে রিকশা নিয়ে ছুটলাম শাহবাগ।
বই খুঁজছি বই, বই...ঐ কটকটে নীল রঙা শার্ট পরা ছেলেটির জন্য। কী করে নীল রং জলে ফেলে আসমানী রঙে সাজতে হয়, সাজাতে হয়...তার এক হাজার একশ পঞ্চাশটি তরিকা লেখা যে বইয়ে, সেই বই। অবশেষে পেলাম, শুভংকর আর নন্দিনীকে। বইয়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে ওদের কথোপকথের শিহরণে ভেতরে হঠাৎ মেঘ চেঁচালো, 'সমস্ত ভুল, সমস্ত ভুল?'
ভুল মাড়িয়ে ছুটলাম, পিছনে রইল আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের ডিপো আর বুকে রইল শুভংকর আর নন্দিনীর গাঢ়তম ওম। দূর থেকে দেখি, সে দাঁড়িয়ে আছে। ঐ নীল শার্ট পরিহিত ছেলেটির কাছে যেতে যেতে "আমার আনন্দের ভিতরে অনর্গল কথা বলছিল আর্তনাদ/আর্তনাদের ভিতরে গুনগুন গলা ভাঁজছিল অদ্ভুত এক শান্তি/আর শান্তির ভিতরে সমুদ্রের সাঁই সাঁই ঝড়।"
ঝড়ে উড়লাম পুনঃপুন। উড়ে উড়ে পূর্ণেন্দুর কথোপকথনের পাঁচ খণ্ড নীল শার্ট পরা যুবকের হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম, 'এরপর থেকে এই বিচ্ছিরি রঙের শার্টটা যেন কোনোদিন পরতে না দেখি...আর এই বইটা পড়বেই পড়বে।' আমার কথা ফুরাতে না ফুরাতেই ছেলেটি হাসতে শুরু করলো। অমন গা জ্বালানো ক্যাটক্যাটে রঙের আভরণে জড়ানো মানুষও যে রংধনু হাসি হাসে, অবাক হয়ে সেই প্রথম জানলাম। তা জেনেশুনে আমি যতই অবাক হই, সে ততই হাসে। টের পেলাম হাসির আলোড়নে আমার সর্বাঙ্গ টলমল জল জল। জলডোবা আমি মুখ তুলে দেখলাম, সে হাসি শুভংকরের!