পড়ুয়া

Share this post

লাল শালুকের ঘ্রাণ

www.porua.net

Discover more from পড়ুয়া

বই নিয়ে পাঠকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো প্রকাশের তেমন সুযোগ থাকে না। পাঠকের বলা না হয়ে ওঠা সেইসব কথাগুলো প্রকাশের ভাবনা থেকে আমরা শুরু করছি পাঠকের জন্য "পড়ুয়া"।
Over 2,000 subscribers
Continue reading
Sign in

লাল শালুকের ঘ্রাণ

নিবেদিতা আইচ

Apr 24, 2023
Share this post

লাল শালুকের ঘ্রাণ

www.porua.net
Share
a pink flower sitting on top of a body of water
Photo by Jaman Asad on Unsplash

আমাদের বাসার স্টোররুমে কার্টন ভর্তি পুরনো জিনিসপত্র থাকত। মাঝেমাঝে এসব বইখাতা, মেয়াদোত্তীর্ণ কনটেইনার এবং আরো অনেক বাজে জিনিসপত্র জমে গেলে কেজি দরে বিক্রি করে দেয়া হতো। আমার তখন ফ্রকবেলা। ভরদুপুরে একা একা ছাদে যাওয়া বারণ। বিশেষ করে শনি মঙ্গলবার তো ভূত-পেত্নীরা বসেই থাকত আমার মতো দুষ্টুদের ধরে নিয়ে যাবার জন্য। তো এমন সব দুপুরে আমি ঘরের ভেতরেই অভিযানে নামতাম। প্রায়ই হানা দিতাম স্টোররুমে। ইঁদুর আর তেলাপোকার ভয়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গুপ্তধন খুঁজে বেড়াতাম সারা দুপুর। গুপ্তধন বলতে পুতুলের জন্য একটুকরো কাপড় কিংবা রাংতা, নয়ত দু’একটা মার্বেল বা খুঁজে না পাওয়া বই! এভাবে একদিন উদ্দেশ্যহীনভাবে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে কার্টনের মধ্যে পেয়ে গেলাম বাবার দেওয়া প্রথম বই- ‘টুনটুনির বই’! সবুজ মলাটের এই বইটা খুঁজে পেয়ে আমি তো খুশিতে দশ-বারো খানা হয়ে গেলাম। কীভাবে অদরকারি জিনিসের মধ্যে ওটা চলে গেল তা ভেবেও রাগ লাগছিল। ‘টুনটুনির গল্প’টা পড়ে টুনটুনিকে কল্পনায় দেখতে পেতাম। ‘বাঘের উপর টাগ’ গল্পটাও বোধ হয় এই বইতে পেয়েছিলাম। ভীতু বাঘের টাগের ভয়ে পালাবার দৃশ্যটা ভাবলে প্রতিবারই হেসে কুটিকুটি হতাম।

এই বইটার সাথে আরো একটা মলাটহীন বই বের হলো কার্টন থেকে। প্রথমদিকের বেশ কিছু পাতার হদিশ মেলেনি। বইয়ের নাম পেলাম প্রতি পৃষ্ঠার তলায়। সূয্যিমামার রথে। নিজের চেষ্টায় সাদা রঙের একটা মলাট লাগিয়ে বইটার উপর কাঁচা হাতে প্রচ্ছদ আঁকলাম। সূয্যিমামার রথের প্রতিটা গল্প এমন অদ্ভুত আর মজার ছিল! এই বইয়ের ‘উল্টাবিবি’ গল্পটা পড়ে উল্টাবিবির মুখটা কল্পনা করতাম। সেই যে স্রোতের উল্টোদিকে ভেসে যেতে যেতে হাত নেড়ে দেখাচ্ছে তলোয়ার দিয়ে ধান কাটবার ভঙ্গি! সেই দৃশ্য ভাবলে এখনো হাসি পায়।

পড়ুয়া is a reader-supported publication. To receive new posts and support my work, consider becoming a free or paid subscriber.

‘আম আঁটির ভেঁপু’র স্থান ছিল মাথার কাছে বালিশের পাশে। তাই ঘুমের দেশে অপুর সাথে সাথে আমিও ছুটতাম, ‘বড় বড় কানের ওটা কী?’ বলে চেঁচিয়ে উঠতাম। ডাগর চোখের দুর্গা আম কুড়িয়ে এনে আমাকেও ভাগ দিয়েছে। আঁটির ভেঁপুতে ফুঁ দিতে দিতে ওদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছি।

শঙ্কুসমগ্র হাতে এসেও সেই একইরকম মজার কান্ড হলো। ঘুমানোর আগে দুয়েক পাতা পড়ে নিলেই স্বপ্নে প্রফেসরের সাথে দিব্যি এডভেঞ্চারে নেমে পড়া যেত! ভুটিয়া দোকানের সামনে বসে সাম্পা খেতে খেতে অবিনাশ বাবুর সাথে গল্প করা যেত। ডুলুং ডোতে একশৃঙ্গ অভিযানে আকাশে ওড়া যেত। কিংবা কর্ভাসের মতো একটা পাখির মালিকও হয়ে যেতে পারতাম।

একটু বড় হয়ে, সম্ভবত যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে রবি ঠাকুরের গল্পগুচ্ছটা হাতে নিলাম। ততদিনে গীতবিতান আমার প্রিয়তম বই হয়ে গিয়েছে। এবার গল্পগুচ্ছ যোগ হলো। এর রেশ পরবর্তী তিন চার বছর তীব্রভাবে থেকে গিয়েছিল। কিছু গল্প আমি প্রায় প্রতিদিন পড়তাম। এতবার পড়েছিলাম বলে সেগুলো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ঐ বয়সে সমাপ্তি, জয়পরাজয়, দৃষ্টিদান, গুপ্তধন, সুভা এই গল্পগুলো ভীষণ ভালো লাগতো। এরপর যোগ হলো পোস্টমাস্টার, ক্ষুধিত পাষাণ, নষ্টনীড়, অপরিচিতা এবং আরো অনেকগুলো গল্প। এসব গল্পের মধ্যে তখন সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিল মৃন্ময়ী চরিত্রটি। ওকে মনে হতো স্বচ্ছজলের স্রোতস্বীনির মতো।

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের মধ্যে 'গোরা' পড়ে সে সময় ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। অন্যদিকে শরৎচন্দ্র রচনাসমগ্র পড়তে শুরু করলে 'দেবদাস' নয়, আমার ভালো লেগে যায় 'দত্তা' উপন্যাসটি। গোরার ললিতা যেমন প্রিয় হয়ে ওঠে ওদিকে ভালো লেগে যায় দত্তার বিজয়াকেও। আমার আলাদা করে ভালো লাগলো 'অরক্ষণীয়া'র জ্ঞানদাকেও। তবে এদের সবাইকে ছাপিয়ে ভালো লাগায় অদ্বিতীয় হয়ে ওঠে দত্তার 'নরেন্দ্রনাথ'। সহজ বাংলায় এই চরিত্রটির প্রেমে পড়ে যাই আমি, ঘোরতর প্রেমে। বোধ হয় তখন থেকেই কবিতা লেখার জন্য আমার হৃদয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তখন মানে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষ। একদিনের কথা বলি৷ সম্ভবত প্রাণীবিদ্যার ক্লাসে রোলকল চলছে সেদিন। পাশে বসা বন্ধুটির সাথে কদিন ধরে নরেনের গল্প করেছিলাম। সেও দুদিনের মধ্যে দত্তা পড়ে ফেলেছে আর আমার মাধ্যমে আহিত হয়ে নরেনের প্রেমে পড়ি পড়ি অবস্থায় আছে তখন। ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলাম নিজের ওপর। পরে ভেবেছি থাক, এমন বায়বীয় প্রেমে কেউ ভাগ বসালেও কিছু যায় আসে না, তাছাড়া বন্ধুই তো, ইত্যাদি। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে জানালার বাইরে দেখছিলাম আমি। হঠাৎ কী হলো জানিনা, দেখলাম কনুই দিয়ে বন্ধুটি গুঁতোচ্ছে আমাকে। ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই বললো- তোর রোল চলে গেল তো!

আমার মতো মনোযোগী ছাত্রীর জন্য এই ধরনের উদাসিনতাটা খুবই বিরল ঘটনা ছিল। ওর কথা শুনে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তারপর আবার জানালার বাইরেই তাকালাম। টের পেলাম সে হাঁ করে দেখছে আমাকে। রোল মিস করার জন্য নয়, আমার হতাশার কারণ ছিল হৃদয়ঘটিত। আমি ভাবছিলাম বাস্তবে যার জীবনে তখনো নরেনের অস্তিত্ব নেই তার তো ক্লাসে অনুপস্থিত থাকাই উচিত। শরীর ওখানে থাকলেও মন তো অনুপস্থিতই ছিল আমার।

নরেনের পর বোধ হয় বুদ্ধদেব গুহর ‘মাধুকরী’তে অন্যমনস্ক পৃথু ঘোষকে ভালো লেগেছিল আমার। আর ভালো লেগেছিল প্রকৃতিকে, যেমন লেগেছে বিভূতির ‘আরণ্যক’ পড়তে গিয়েও।

তবে গল্প উপন্যাসের পুরুষ চরিত্রের চেয়ে নারী চরিত্রের সংখ্যাই বেশি ছিল এবং আছে যারা আমাকে সত্যিকারভাবে আকৃষ্ট করেছে বিভিন্ন সময়ে। ‘কালবেলা’র অনিমেষের চেয়ে মাধবীলতা প্রিয়তর ছিল আমার কাছে। ‘দূরবীন’ এর ধ্রুব তো ছিল ভীষণরকমের অপ্রিয়। ‘প্রথম আলো’র ভূমিসূতা আরেকটি প্রিয় চরিত্র। ‘সুদূর ঝর্ণার জলে’র মার্গারিট এখনো ফুল হয়ে ফোটে আমার স্মৃতিতে। ‘সবিনয় নিবেদন’ এর প্রাণবন্ত ঋতি রায় অন্যতম প্রিয় চরিত্র। ‘কাছের মানুষ’ এর তিতিরকে ডাকলে হয়ত পোস্তদানা মন নিয়ে এখনো সে আমার সঙ্গে গল্প করবে। এদের সবার মধ্যে ‘গান্ধর্বী’ এর অপালা আমার প্রিয়তম চরিত্র, বোধ হয় সবসময়ের জন্য।

যেসব চরিত্রের নাম উল্লেখ করেছি এতগুলো বছর পর আবার পড়তে শুরু করলে এদের অনেককেই আমি প্রথমবারের সাথে মেলাতে পারবো না। সময়ের সাথে পাঠকের রুচি, জীবনবোধ পরিবর্তিত হয়, চিন্তাভাবনা আগের চেয়ে গোছানো হয়, মানসিক পরিপক্বতা আসে। এই ব্যাপারগুলি বিবেচনা করি বলেই হয়ত প্রিয় বইগুলো সচেতনভাবে এড়িয়ে যাই আজকাল। কৈশোর আর যৌবনের মেদুর স্মৃতিতে যেসব চরিত্র আমাকে আছন্ন করে রাখতো তারা তেমনিই থাকুক লাল শালুকের ঘ্রাণের মতো পুরনো সেই আমেজ নিয়ে। এই বড়বেলার রুক্ষতা স্মৃতির পেলবতাকে ছুঁয়ে না যাক।

পড়ুয়া is a reader-supported publication. To receive new posts and support my work, consider becoming a free or paid subscriber.

Share this post

লাল শালুকের ঘ্রাণ

www.porua.net
Share
Previous
Next
Comments
Top
New
Community

No posts

Ready for more?

© 2023 Riton Khan
Privacy ∙ Terms ∙ Collection notice
Start WritingGet the app
Substack is the home for great writing