আমাদের সুন্দর স্বপ্নের একটা শান্ত পথ। সেই পথ বেয়ে উঠে আসে নানা রঙ, নানা শব্দ, সেই পথেই দেখা হয় স্বপ্নবাজ কিছু তরুণ-যুবার সাথে। তারপর স্বপ্নগুলো লাল-সবুজে মেশে পরস্পর। লাল সবুজের স্বপ্ন সতত সুন্দর।
সহজিয়া ভাবনা। ভাবনাটা এ রকম যে, আমরা নাগরিক জীবনে শৈশব কাটিয়েছি অসাধারণ সব গল্পের বই পড়ে। পাঠ্যবই এর পাশাপাশি সেই সব বই আমাদের কল্পনার জগতকে করেছে রঙিন, স্বপ্নকে করেছে বর্ণিল। আমাদের মুঠোয় এনে দিয়েছে তেপান্তর। শহরের বাচ্চাদের সেই সব গল্পের বই পড়ার সুযোগ ঢের। গ্রামের, কিংবা একটা মফস্বলের প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের কি সেই সুযোগ আছে? পড়তে পারে ওরা সূর্যের দিন কিংবা আমার বন্ধু রাশেদ? নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় পড়ে ওরা কি দমবন্ধ অনুভূতিতে মেতে ওঠে অদৃশ্য এডভেঞ্চারে?
পাবনায় বেড়াতে গিয়ে দাদবাড়ির অদূরে প্রাইমারি স্কুলের সবুজ মাঠে হাঁটছিলাম। হঠাৎ ভাবনাটা মাথায় টোকা দিলো। খপ করে ধরে ফেললাম সেই অপার্থিব টোকা-টাকে। ভাগাভাগি করলাম আমার পাশের মানুষ, মিশুর সাথে।
গীতিকার আর স্থপতির একটা স্বপ্ন হাওয়াই মিঠাই হলো অতঃপর...
কথাটা অনেক পুরানো কিন্তু সত্যি ভীষণ, 'চ্যারিটি বিগানস এট হোম'...আমি আর মিশু বই কেনা শুরু করে দিলাম, আর বই কেনার জন্য পরিবারের স্বজনদের কাছে আবেদন জানালাম। এভাবেই শুরু...তারপর এগিয়ে এলেন একজন বই অন্তঃপ্রাণ চিকিৎসক, এগিয়ে এলেন স্থপতি, এগিয়ে এলেন শিক্ষক, গীতিকার আরো অনেকে...হয়ে গেলো লাল সবুজ বই ঘর এর প্রথম বই ঘর। পাবনার চকদুবলিয়া গ্রামে।
স্বপ্ন কি থেমে থাকে? আমাদের আগ্রহ বাড়তে লাগলো বিপুলা গতিতে। বছর না ঘুরতেই লাল সবুজ বই ঘর এর দ্বিতীয় লাইব্রেরি হলো নরসিংদিতে। এবার কান্ডারি হলো মুন। সাথে মাশরুর,টিটো, পাভেল, দীপ্র আর নাম না জানা মুনের বন্ধুরা। কি দারুণ সব মানুষজন শিশুদের জন্য বই কিনে দিলেন। ধন্যবাদ বন্ধুগণ, ধন্যবাদ।
সেই পালাক্রমে আমরা উদ্বোধন করে এলাম লাল সবুজ বই ঘর এর তৃতীয় লাইব্রেরি। প্রায় ২৩৭ টা বই দিয়ে বাচ্চাদের জন্য এই লাইব্রেরি উদ্বোধন হলো অসাধারণ কিছু মানুষের আগ্রহে আর কিছু প্রকাশকের সহায়তায়। এবার এগিয়ে এলেন মাশরুর, জেরিন, সুইটি। পি এইচ ডির যন্ত্রণার ভিতরেও মিশু থাকলেন একনিষ্ট হয়ে লাল সবুজ বই ঘর এর জন্য। মুন তো থাকলেনই সবার অগ্রভাগে।
প্রাইমারি স্কুল নির্বাচিত হলো মানিকগঞ্জের ঘিওরে জাবরা ১ নং প্রাথমিক বিদ্যালয়। মুক্তিযোদ্ধা এবং এই স্কুলের সভাপতি জনাব মমিন উদ্দিন খান লাল সবুজ লাইব্রেরির জন্য একটা আলমারি-ই শুধু বানিয়ে দিলেন না, পুরো একটা রুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিলেন যাতে বাচ্চারা বসে আরাম করে বই পড়তে পারে। পাঞ্জেরি আমাদের উদ্যোগের কথা জেনে শিশুদের উপযোগী ৪০ টা বই দিয়ে দিলেন। বই নিয়ে আগের মতোই চলে আসলেন চর্যাপদ।
আমরা চাই অন্তত ১০ টা প্রাইমারি স্কুলে এ রকম লাইব্রেরি করে দিবো শিশুদের জন্য,দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বাংলাদেশে সরকারী, বেসরকারী মিলিয়ে প্রায় ৮০ হাজারের কাছাকাছি প্রাইমারি স্কুল আছে। অন্তত ১০ টা স্কুলে করে দেয়ার পর লাল সবুজ বই ঘরের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে যাবে একদিন সমস্ত প্রাইমারি স্কুল বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। একদিন, কোনো একদিন...দেশের সব প্রাইমারি স্কুলে একটি করে লাইব্রেরি থাকবে শিশুদের জন্য। মন ও মননে অনেক বড় হবে এই কোমলমতিরা।
বইগুলো আলমিরাতে গুছিয়ে দিয়ে রেজিস্টার্ড খাতায় এন্ট্রি করে আমরা যখন ধূলি ওড়া পথে ফিরছিলাম, প্রশান্তি আর প্রাপ্তির অনির্বচনীয় আনন্দে হাসি হাসি মুখ ছিলো আমাদের।
নতুন মোড়কে, রঙিন সব বই হাতে পেয়ে চকচকে চেহারার সেই শিশুটি ভালো থাকুক। যে একদিন স্বপ্নে অনেক বড় হবে, সেই স্বপ্নের চাষবাস করবে জীবনে, যাপনে।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়...