পড়ুয়া

Share this post

লাইব্রেরি

www.porua.net

Discover more from পড়ুয়া

বই নিয়ে পাঠকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো প্রকাশের তেমন সুযোগ থাকে না। পাঠকের বলা না হয়ে ওঠা সেইসব কথাগুলো প্রকাশের ভাবনা থেকে আমরা শুরু করছি পাঠকের জন্য "পড়ুয়া"।
Over 2,000 subscribers
Continue reading
Sign in

লাইব্রেরি

শামসুর রাহমান

Jan 5, 2023
Share this post

লাইব্রেরি

www.porua.net
Share
an old library
old library © riton khan

ইশকুলে যাওয়ার পথে পাটুয়াটুলিতে রামমোহন লাইব্রেরির উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করিনি। কেউ আমাকে বলে দেয়নি সেই লাইব্রেরির সদস্য হতে, নিজেই উদ্যোগ নিলাম, সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে লাইব্রেরি থেকে বই ধার নেওয়ার সুযোগ-সুবিধা পেলাম। ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত এই গ্রন্থাগার আমার সামনে খুলে দিল আলাদা এক জগৎ, বেড়ে গেল আমার পাঠস্পৃহা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আরও বেশি পরিচয় তো হলই, বঙ্কিমচন্দ্র এবং শরৎচন্দ্রের সঙ্গেও পরিচিত হয়ে উঠলাম। রামমোহন লাইব্রেরিসংলগ্ন দালানে জীবনানন্দ দাশের বিবাহ-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এই তথ্য অবশ্য পরে জেনেছি। কারণ, তখনও জীবনানন্দের অস্তিত্ব আমার কাছে অজ্ঞাত। ভাবতে অবাক লাগে, তখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা নয়, গদ্য রচনাই আমাকে আকর্ষণ করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র ও শরৎচন্দ্র—এই দু’জনের কেউই কবি ছিলেন না।

কলেজের লাইব্রেরিতে যেতাম কখনওসখনও। মনে পড়ে লাইব্রেরি থেকে ধার নিয়ে রোমা রঁলার ‘জাঁ ক্রিস্তফ’ পড়েছিলাম। এই মহৎ উপন্যাসের গভীরতা তখন বোধহয় পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারিনি আমার ছটফটে স্বভাবের দরুন, কিন্তু এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে, এ ধরনের বই পড়লে নিশ্চিত আত্মশুদ্ধি ঘটে। বিরাট কোনও মনের সংস্পর্শে এলে সেই বিরাটত্বের ছায়া নিজের মানসে পড়ে। এটা কম উপকারী নয়। একদিকে ‘জাঁ ক্রিস্তফ’-এর মতো বই পড়ছি রাত জেগে, অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তকের প্রতি দেখাচ্ছি চরম অবহেলা। ক্লাস ফাঁকি দিয়েছি প্রচুর। মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, হারামণির বিখ্যাত সংকলক, আমাদের বাংলা পড়াতেন। ক্লাস নেওয়ার সময়ে প্রায়শই ক্লাসরুমের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। না, তাকিয়ে থাকা শব্দ দু’টি ব্যবহার করা ঠিক হল না। তার চক্ষুদ্বয় বন্ধ থাকত। তাই তাঁর ঊর্ধ্বচারী নিমীলিত নেত্রের সুযোগ নিয়ে ক্লাস পালানো ছিল সহজ। প্রক্সি দিয়ে দাও ছুট ‘ব্রিটানিয়া’ সিনেমা হলের দিকে। ‘ব্রিটানিয়া’ ছিল তখনকার অভিজাত সিনেমা হল, যেখানে শুধু ইংরেজি ফিলম্‌ দেখানো হত। ব্রিটানিয়ায় ম্যাটিনি শোতে বহু নামজাদা ফিল্‌ম দেখেছি। পল মুনি অভিনীত একাধিক ছবি সেখানেই দেখি। ‘গ্রেটা গার্বো’ এবং চার্লস বয়ারের ‘ম্যারি ওয়ালেঙ্কা’ও দেখি ব্রিটানিয়ায়। কলেজ জীবনের অনেক দুপুরের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে বহুকাল আগে লুপ্ত ঐ সিনেমা হলটিতে।

পড়ুয়া is a reader-supported publication. To receive new posts and support my work, consider becoming a free or paid subscriber.

চামড়া-পোড়ানো, চোখ-ঝলসানো রোদ্দুরের ভেতর দিয়ে আমার প্রিয় অধ্যাপক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর বাসার দিকে এগুনোর পথে ওয়াগনের বাসিন্দাদের কথা, ওদের দুর্দশার কথা ভাবছিলাম। শিক্ষকের কবিতা লেখার প্রস্তাব তখন আমার ভাবনা থেকে গায়েব। স্যারের বিনীত ড্রইংরুমের চেয়ারে বসে এক গ্লাস পানি গলায় চালান করে, দুটো সন্দেশের সৎকার সেরে, ফ্যানের হাওয়া খেয়ে বেশ তৃপ্তি হল। ঘরের চার দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো অনেকগুলো র‍্যাকে সাজানো বই আর বই। দেখে চোখ-প্রাণ ঔৎসুক্যে, লোভে চকচক করছিল, অনুভব করছিলাম। স্যার নিশ্চয়ই টের পেয়েছিলেন। তিনি সুন্দরভাবে বললেন, ‘তোমার জন্যে অবাধ আমার লাইব্রেরি। এখানে বসে ইচ্ছেমতো বই পড়তে পার। ইচ্ছে হলে বই বাড়িতেও নিয়ে যেতে পার। আমার তরফ থেকে কোনও বাধা নেই।’ আমার শিক্ষকের কথা শুনে মন জুড়িয়ে গেল। তাঁর লাইব্রেরি থেকে বেশ কয়েকটি ভালো বই এনে পড়েছিলাম। তার একটি কি দু’টি বই আমার কাছে শেষতক রয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ে। তবে দুঃখের বিষয়, আজ সেই বই আমার বইয়ের ভাণ্ডারে অনুপস্থিত। পুরনো ঢাকার পুরনো বাড়িতে দীর্ঘকাল বসবাস করার ফলে আমার অনেক বইয়ের সঙ্গে সেই দু’টি বইও বেনোজলে আর কীটের দংশনে নষ্ট হয়ে গেছে। স্যার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ধমকে খুব তাড়াহুড়ো করে একদিন ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। আমার শিক্ষক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর মুখ প্রায়শই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, শুনতে পাই তার কণ্ঠস্বর। কী করে ভুলব তার স্নেহস্পর্শ?

একদিন বেলা একটু পড়ে গেলে হেঁটে এসএম হলে ওবায়দুল্লাহর কামরায় গিয়ে হাজির হলাম। হন্তদন্ত ওবায়দুল্লাহ আমাকে দেখে তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেছেন। আমার সামনে একটি কাগজ রেখে তৎক্ষণাৎ সই করতে বললেন, যেন এক্ষুনি ট্রেন ছেড়ে দেবে। এসএম হলের নির্বাচনে আমাকে লাইব্রেরিয়ানের পদে প্রতিযোগিতা করতে হবে। আমার মাথায় বাজ পড়ল যেন। আমি দু’হাতে বারণ করলাম। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ছাড়বার পাত্র নন। আখেরে আমাকে হার মানতে হল। ওবায়দুল্লাহ জয়েন্ট সেক্রেটারির পদে প্রার্থী। এরপর শুরু হল এসএম হলের প্রতিটি রুমে যাওয়া এবং ভোট প্রার্থনা করার পালা। ব্যাপারটা, কবুল করছি, আমার পক্ষে মোটেই সুখকর ছিল না। অবশ্য আমাকে কোনও কথা বলতে হয়নি। আমার পক্ষে ভোট প্রার্থনা করেছেন ওবায়দুল্লাহ এবং আরও কেউ কেউ। আমি শুধু নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতাম অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে। নির্বাচন হল যথাসময়ে। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার একটা দুর্ভাবনা ছিল, কিন্তু তরী কৃতিত্বের সঙ্গেই ভিড়ে গেল তীরে। বিপুল ভোটে পাস করলাম। আমরা সবাই প্রফুল্ল চিত্তে কয়েকদিন এসএম হলে ঘুরে বেড়ালাম। বিজয়ী দলের ফটোও তোলা হল। লুকাব না, কয়েকটি দিন ভালো লেগেছিল। লাইব্রেরিতে যেতে, সেখানে বসে পড়াশোনা করতে ভালোই লাগে আমার। সুযোগ পেলে এখনও ভালো গ্রন্থাগারে সময় কাটাতে ইচ্ছা করে। যৌবনের প্রত্যুষে রামমোহন লাইব্রেরিতে প্রচুর সময় কেটেছে বই নেড়েচেড়ে এবং পড়ে। কিন্তু কেন জানি, এসএম হলের লাইব্রেরি আমাকে টানেনি। আমি একদিনও সেখানে প্রবেশ করিনি, দূরে সরে রয়েছি সবসময়। লাইব্রেরিটি কেন জানি একটি কবরের মতো মনে হত!

৩০ নম্বর আশেক লেনের পুরনো বাড়ির কথা, ইউনিভার্সেল প্রেসের কথা, কমরেড লাইব্রেরির কথা। আমার পিতামাতার ভাইবোনের, আমার স্ত্রী ও সন্তানদের এবং আমার নিজের কত স্মৃতি জড়িত সেই বাড়িটির সঙ্গে। কী করে ভুলব সেসব দিনের কথা? অনেকগুলো বছর কাটিয়েছি সেই বাড়িতে। কত কবিতাই না লিখেছি, কত রাত-জাগা প্রহরই না আমার কেটে গেছে কবিতা পড়ে আর কবিতা রচনা করে। আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে উঠোনোর মাটি, সবুজ ঘাস, ঘাসে সাদা বেড়ালের বিশ্রাম, ফুলের গাছ, গেটের শরীরে নীল অপরাজিতা ফুলের গাছের লতার জড়িয়ে থাকা। বর্ষার মওসুমে উঠোনে এক হাঁটু পানি, রাস্তার হালও তথৈবচ। মনে পড়ে, চওড়া বারান্দায় আম্মার পায়চারি, দূরের চাঁদ আর তারার ঝিলিমিলি দেখা। রাতে বাড়ি ফেরার সময় আমাদের গেটের সামনে গলিবাসী এক মাতালের নিরীহ মাতলামি, আর আবোলতাবোল কথা, কমরেড লাইব্রেরির নিষ্ঠাবান কর্মচারী টুপি-পরা সিরাজ মিয়ার ঝুঁকে পাঠ্যপুস্তকের প্রুফ দেখা, বিকেলবেলা ইউনিভার্সেল প্রেসের অফিস-কামরায় আব্বার বসে থাকা আর আমাদের গ্রাম পাড়াতলী থেকে আসা অতিথির সঙ্গে আলাপে মগ্ন হওয়া—অনেক কিছুই ফুটে ওঠে স্মৃতির আয়নায়।

লেখকের বানানরীতির পরিবর্তন করা হয়নি।

Share this post

লাইব্রেরি

www.porua.net
Share
Previous
Next
Comments
Top
New
Community

No posts

Ready for more?

© 2023 Riton Khan
Privacy ∙ Terms ∙ Collection notice
Start WritingGet the app
Substack is the home for great writing