পড়ুয়া

Share this post

সবচেয়ে ভালো সময় কাটে লাইব্রেরিতে

www.porua.net

Discover more from পড়ুয়া

বই নিয়ে পাঠকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো প্রকাশের তেমন সুযোগ থাকে না। পাঠকের বলা না হয়ে ওঠা সেইসব কথাগুলো প্রকাশের ভাবনা থেকে আমরা শুরু করছি পাঠকের জন্য "পড়ুয়া"।
Over 2,000 subscribers
Continue reading
Sign in

সবচেয়ে ভালো সময় কাটে লাইব্রেরিতে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

Jan 5, 2023
Share this post

সবচেয়ে ভালো সময় কাটে লাইব্রেরিতে

www.porua.net
Share

স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে আশু অর্থাৎ আশুতোষ ঘোষ আমাদের বাড়ির সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। এ-ছাদ থেকে ও-ছাদ দেখা যায়, আমাদের গলি থেকে বেরিয়ে দু’পা গেলেই ওদের সদর। বড় রাস্তার ওপর বাড়ি, বনেদি দু’মহলা, দোতলায় দুটি ঝুল বারান্দা। একতলায় অনেক খালি ঘর পড়ে থাকে, দোতলায় ওঠার চওড়া কাঠের সিঁড়ি, কার্পেট পাতা, ইদানীং তা ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে অবশ্য, দোতলার দীর্ঘ দালানটি সাদা-কালো মার্বেলে চকমেলানো, একটি হলঘরে পুরনো আমলের সোফাসেটি, ঝাড়লণ্ঠন, দেওয়ালে বড় আকারের কয়েকটি ছবি, ইউরোপীয় চিত্রকরদের, আসল নয়, কপি। খাঁটি কলকাতার কায়েত যাকে বলে, ঘোষ-বোস-মিত্তির-দত্ত ইত্যাদি, ইংরেজ আগমনের পর এঁরাই এখানকার অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন, দূরদর্শিতার অভাবে সেসব ধরে রাখতে পারেননি, অবাঙালি ব্যবসায়ীরা এসে আস্তে আস্তে সব কুক্ষিগত করে নেবার পর এই কায়স্থ কুলতিলকদের সকলেরই অবস্থা তখন পড়ন্ত, এই ঘোষবাড়িটি সেই বিগত-মহিমা সম্প্রদায়েরই অন্তর্গত।

এই বাড়িতে গিয়েই আমি কলকাতা কালচারের প্রথম স্বাদ পাই। আশুরা অনেক ভাই-বোন। একজন স্থায়ী শিক্ষক নিযুক্ত আছেন, তিনি থাকেন ও বাড়িতেই, সব ছেলেমেয়েদের পালা করে পড়ান। ওদের নিজেদেরই জন্য একটি লাইব্রেরি, পাড়ার ছেলেমেয়েরাও বই নিতে পারে সেখান থেকে। আশু ক্লাসের ভালো ছেলে, অনেক গল্পের বইও পড়ে, গান-বাজনার দিকে ঝোঁক আছে, খেলাধুলোও ভালোবাসে। আমাদের মতন গরিব বাড়িতে খাওয়া-পরার চিন্তাই প্রধান, ভবিষ্যতে চাকরি জোটানোর জন্য মন দিয়ে পড়াশুনো করতে হবে, এটাই ছিল পারিবারিক নির্দেশ, সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, খেলা এগুলিও যে জীবনযাপনের অঙ্গ, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবার সময় পায়নি। এর আগে আমার খেলাধুলো বলতে ছিল ঘুড়ি ওড়ানো, গলির ছেলেদের সঙ্গে ড্যাংগুলি খেলা, (গাংগুলির সঙ্গে ড্যাংগুলির বেশ মিল দেওয়া যায় বলেই বোধহয় ওই খেলাটা আমি ভালোই পারতাম)আর চু-কিত কিত। পেছন দিকের বস্তির ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ ছিল, তারা সোডার বোতলের ছিপি ও বাটখারা দিয়ে একটা খেলা খেলত, সেটা দেখে প্রলুব্ধ হয়ে আমি গোপনে কয়েকবার তাদের সঙ্গে ওই খেলাতে যোগ দিয়েছি। আশুদের বাড়িতে প্রশস্ত উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলা হয়। কিছুদিন পর ঠাকুরদালানে টেবিল টেনিসের বোর্ড বসেছিল। আশু ভালো সাইকেল চালায় বলে আমিও সাইকেল শিখতে উদ্বুদ্ধ হলাম। আমাদের বাড়িতে গল্পের বই প্রায় ছিলই না, বাবার এদিকে ঝোঁক নেই, সময়ও পেতেন না। আমার মায়ের ছিল বই পড়ার নেশা, এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে বই পড়তেন, আরও দু’-এক বছর পর মায়ের নামে বয়েজ ওন লাইব্রেরিতে মেম্বারশিপ নেওয়া হয়, প্রায় প্রতিদিন মায়ের জন্য দু’খানা করে বই আনতাম আমি। এবং মায়ের নেশার উত্তরাধিকার সূত্রে আমিও সে বই শেষ করি, তথাকথিত বড়দের বই হলেও কিছু যায় আসে না।

তার আগে, আশুদের বাড়ির লাইব্রেরিতে অনেক ছোটদের বই পেয়ে আমি দারুণ ক্ষুধার্তের মতন সেসব বই কামড়ে কামড়ে খেতে শুরু করেছি। আবিষ্কার করি হেমেন্দ্রকুমার রায়কে, শিবরাম চক্রবর্তীকে। দমদম মতিঝিলে আমার মায়ের মামার বাড়িতেও কিছু বই ছিল।

আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিটি খুব ছোট, সেখানে শুধু সপ্তাহে একখানা বই পাওয়া যেতে পারে। প্রতি শনিবার। তাও আলাদা কোনও লাইব্রেরিয়ান নেই, যে-শিক্ষক মহাশয় ভারপ্রাপ্ত, তিনি কোনও কারণে এক শনিবার অনুপস্থিত থাকলে সিঁড়ির পাশের গ্রন্থাগারটির আর তালা খোলা হত না সেদিন। সপ্তাহে একখানি বই যেন দাবানলে একটি শুকনো পাতা। ক্লাসের সহপাঠীদের মধ্যেও তখন গল্পের বই বদলা-বদলি হয়। আমি সবচেয়ে বেশি বই পেতাম একটি মাড়োয়ারি ছেলের কাছ থেকে, তার নাম কমল ভাণ্ডারি। কমলের বাংলা কথায় অবাঙালি সুলভ টান ছিল, ‘কিন্তু’র বদলে বলত ‘লেকিন’, অথচ বাংলা পড়তে পারত খুব তাড়াতাড়ি। অনেক সময়, ক্লাসের মাস্টারমশাইয়ের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে হাই বেঞ্চের আড়ালে একই গল্পের বই পড়তাম দু’জনে, আমার শেষ হবার আগেই কমল পাতা উল্টে দিত। বলাই বাহুল্য, আমাদের তুলনায় কমলের বই কেনার ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি, নতুন নতুন বই কিনে সে নিজে শেষ করার পরেই বিলিয়ে দিত বন্ধুদের মধ্যে।

আমার সহপাঠী ও প্রতিবেশী আশুদের বাড়ির লাইব্রেরিরও আমি ছিলাম অন্যতম রক্ষক ও ভক্ষক। ঠিক কোথা থেকে মনে নেই, এই সময় আমার হাতে আসে একটি বই, সেটির নাম ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয় গান’, কিংবা এই ধরনের কিছু। তাতে ছিল ক্ষুদিরাম, কানাই, সত্যেন, ভগৎ সিং, সূর্য সেন প্রমুখদের সংক্ষিপ্ত জীবনী। খুব আবেগময় ভাষা, পড়তে গেলে চোখে জল আসবেই। সে বই পড়ে যে কত কেঁদেছি তার ঠিক নেই। শুধু তাই নয়, ভগবানের ওপর খুব রাগ হয়েছিল, কেন তিনি আমাকে আরও অন্তত আট-দশ বছর আগে জন্মাতে দেননি? (আমার জন্মের জন্য মা-বাবা কিংবা ভগবান দায়ী, সে সম্পর্কে সংশয় তখন যায়নি। সে যাই হোক, ভগবানের ওপর দোষারোপ করাই সুবিধেজনক।) আর মাত্র ছ’ সাত বছর আগে জন্মালেও আমি দেশের জন্য ক্ষুদিরামের মতন প্রাণ দিতে পারতাম! আজাদ হিন্দ ফৌজের কত সৈন্য দেশের মুক্তির জন্যই তো লড়াই করতে করতে মরেছে। এখন যারা রয়েছে বিচারের অপেক্ষায়, তারাও হয়তো ঝুলবে ফাঁসির দড়িতে। আর আমি দেশের জন্য কিছুই করতে পারব না?

পরাধীন ভারতে আমার মতন দশ-বারো বছরের ছেলে-মেয়েরা স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনও ভূমিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তখন আমরা বালক না কিশোর? গলা ভাঙেনি, নাকের নীচটা পরিষ্কার, হাফ প্যান্ট পরি। কিশোরদের তবু খানিকটা কদর থাকে বিপ্লবীদের কাছে, কিন্তু বালকরা পাত্তা পায় না। ক্ষুদিরাম তো পনেরো-যোলো বছর বয়েস থেকেই যোগ দিয়েছিল বিপ্লবীদের সঙ্গে। ইস, ক্ষুদিরামের বয়েস আমার থেকে মাত্র চার-পাঁচ বছর বেশি।

দেশের স্বাধীনতা আমাকেও একধরনের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল, একা একা বাড়ির বাইরে ঘুরে বেড়াবার অনুমতি। ঠিক অনুমতি নয়, কৌশলে আদায় করে নেওয়া। বাবা রাত সাড়ে দশটার আগে বাড়ি ফেরেন না। মা ছোট ভাই-বোন ও অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, আমাকে শাসন করবে কে? এত ব্যস্ততার মধ্যেও মা বই পড়ার নেশা ছাড়তে পারেননি। রান্না করতে করতেও বই খুলে রাখতেন, লাইব্রেরি থেকে আমাকেই বই এনে দিতে হয়। মা বয়েজ ওন লাইব্রেরির সদস্যা হয়েছিলেন, নামটা তখন ঠিক বুঝতাম না, বলতাম বয়েজোন। সেখানে ছোট ছেলেদের বদলে বয়স্কদেরই ভিড় দেখছি বেশি। সেখানে গ্রন্থের সংখ্যা প্রচুর, প্রতি সন্ধেবেলা বই আনতে যেতাম, কতক্ষণ লাগবে, তা তো বলা যায় না, এক একদিন ভিড় থাকলে সত্যিই অনেক সময় লাগত, কোনওদিন তাড়াতাড়ি হয়ে গেলে আমি ঘুরে বেড়াতাম এদিক-ওদিক। অর্থাৎ সন্ধেবেলা নিজের পড়া ফাঁকি দিয়ে আমি এই শহরের অলি গলি ঘুরে ঘুরে বাড়িয়ে ফেলতাম আমার চেনা জগতের পরিধি। সেটা সিনেমা থিয়েটারের পাড়া। প্রথমে স্টার থিয়েটার, তারপর রূপবাণী সিনেমা, তার পাশে একটা বিশাল পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ি, অত উঁচু বাড়ি উত্তর কলকাতাতে তো বটেই তখন সারা কলকাতাতেই অঙ্গুলিমেয়, সেই বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তা, সেইখানে লাইব্রেরি, তার একটু পরেই শ্রীরঙ্গম রঙ্গমঞ্চ। প্রবাদপ্রতিম নট শিশিরকুমার ভাদুড়ী সেখানে তাঁর জীবনের শেষ কিছু অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে স্বচক্ষে দেখেছি কয়েকবার, মঞ্চের বাইরে। তখনকার দিনের বিখ্যাত গায়ক ও অভিনেতা ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে, তিনি অন্ধ, তাই লোকের মুখে তাঁর ডাকনাম ছিল কানাকেষ্ট, এই নামটি লেখা হয়তো উচিত হল না, কিন্তু অনেক পোস্টারেও এইনাম ছাপা দেখেছি। এঁরই ভাইপো এখনকার প্রখ্যাত গায়ক মান্না দে। শিশিরকুমার ও কৃষ্ণচন্দ্র খুব বন্ধু ছিলেন, মাঝে মাঝে দেখতাম, ওঁরা দু’জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে খেতে মগ্নভাবে কথা বলছেন। একটি কিশোর একটু দূরে থমকে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকত ওঁদের দিকে। কিশোরটির তখন হাফপ্যান্টের নীচে ঠ্যাংদুটো বিসদৃশ রকমের লম্বা দেখায়, নাকের নীচে সূক্ষ্ম রোমের রেখা, গলার আওয়াজ ভাঙতে শুরু করেছে। কিশোরটি অবাক হয়ে ভাবত, শিশিরকুমার ও কৃষ্ণচন্দ্র, ওঁরা নক্ষত্রলোকের মানুষ। ওঁরাও সাধারণ মানুষের মতন রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খান মাটির খুরিতে? কিশোরটি একদিন গুটি গুটি পায়ে ওঁদের খুব কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, ওঁদের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য। হায়, ওঁরা নাট্য বা সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করছিলেন না, খুব। দুশ্চিন্তিত ছিলেন টাকা-পয়সার অভাব বিষয়ে।

সবচেয়ে ভালো সময় কাটে কোনও লাইব্রেরিতে। ন্যাশনাল লাইব্রেরি আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে, যেতে বাস ভাড়া লাগে। কিন্তু কোনওক্রমে পৌঁছতে পারলে বড় পবিত্র আরাম হয়। বাড়িটি ঐতিহাসিক, চারপাশের বড় বড় গাছপালা ও মখমলের মতন সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। চার পয়সার ট্রাম ভাড়া দিয়ে এসপ্লানেড পর্যন্ত এসে, তারপর ময়দানের মধ্যে দিয়ে কোনাকুনি হেঁটে পৌঁছে যেতাম সেখানে। সদস্যপত্র না থাকলেও একটা কিছু পরিচয়পত্র দেখালেই পাওয়া যেত এক দিনের ছাড়পত্র, তারপর ভেতরে ঢুকে অবাধ বিচরণ। অনেক মানুষ বসে আছে। কিন্তু পড়ুয়ারা কেউ কথা বলে না, নিস্তব্ধ হলঘরে শুধু শোনা যায় কাগজের খসখস শব্দ। ইচ্ছে অনুযায়ী যে কোনও বই পড়া যায়, সেখানেই প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা স্বচক্ষে দেখি, এবং সেই বিস্ময়কর জগতে প্রবেশ করি।

এ ছাড়া ছিল ইউ এস আই এস এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরি। সেখানে বই নিয়ে পড়তে কিংবা বসে থাকতে পয়সা লাগে না। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ি থেকে পায়-হাঁটা দূরত্বে একটা খুব নিরিবিলি লাইব্রেরি আমি আবিষ্কার করে ফেললাম। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের ওপরে ব্রাহ্মসমাজের মন্দির, তার সঙ্গে যুক্ত একটি গ্রন্থাগার। মাঝে মাঝে চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়া ছাড়া অধিকাংশ দুপুরই কাটতে লাগল এখানে। এমন সুন্দর পরিবেশ ও বহু দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ, তবু পাঠকের সংখ্যা খুবই কম, প্রায় দিনই আমি ও গ্রন্থাগারিক ছাড়া আর তৃতীয় কোনও মনুষ্যের মুখ দেখা যেত না। গ্রন্থাগারিক মহাশয়টি কৃশ চেহারার প্রৌঢ়, আমাকে তিনি সস্নেহদৃষ্টিতে দেখতেন। তাঁর কাছে কোনও একটি বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রাসঙ্গিক দশখানি বইয়ের কথা জানাতেন সবিস্তারে।

লাইব্রেরিতে চাকরি নিলে প্রতি মাসে অনেক বেশি টাকা পাঠাতে পারব মা, ভাই-বোনদের জন্য। জীবিকা অর্জনের জন্য অনেক ছেলেই তো প্রবাসে কিংবা বিদেশে থাকে। এখানে আমার পড়াশুনোর সুযোগ অনেক বেশি, বিশাল গ্রন্থাগারটি আমার খুব প্রিয় স্থান, একবার ঢুকলে আর বেরোতেই ইচ্ছে করে না। কলকাতায় ফিরে গেলে আমি কী পাব? পড়ব এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারি চাকরি থেকে বিনা অনুমতিতে পালিয়ে এসেছি, সে চাকরি তো নেই-ই, বরং উল্টে হয়তো শাস্তি পেতে হতে পারে। অন্য কোনও চাকরির জন্য আবার দাঁড়াতে হবে কত শত ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে? সংসার খরচ জুটবে কোথা থেকে? বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে আমার শূন্যস্থানটাও কি ফিরে পাওয়া সম্ভব? খাঁচার বাঘ কোনও ক্রমে জঙ্গলে ফিরে গেলে অন্য বাঘেরা আর তার গায়ের গন্ধ পছন্দ করে না। আমার গায়ে আমেরিকান গন্ধ পেয়ে যদি বন্ধুরা নাক সিঁটকোয়?

এরই মধ্যে আর একবার গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ানায় ব্লুমিংটন শহরে প্রতিভা বসু-বুদ্ধদেব বসুর কাছে। ওঁদের ছেলে শুদ্ধশীল অর্থাৎ পাপ্পা কয়েকবার এসে থেকে গেছে আমার কাছে। পাপ্পা আমায় খুব ভালোবাসত, কলকাতাতেও আমার সাহচর্য তার খুব পছন্দ ছিল, তার বুদ্ধিদীপ্ত, সরস কথাবার্তায় আমিও মুগ্ধ ছিলাম। আয়ওয়ায় এসে মার্গারিটের সঙ্গেও বেশ ভাব হয়েছিল পাপ্পার। এমনও হয়েছে, পাপ্পারই অনুরোধে একই বিছানায় তিনজন পাশাপাশি শুয়ে গল্প করেছি সারা রাত।

পাপ্পা ঘন ঘন টেলিফোন করত। তার ডাকেই আবার গিয়েছিলাম ব্লুমিংটন। দময়ন্তী অর্থাৎ রুমি সম্ভবত ততদিনে চলে গিয়েছিল অন্য বাড়িতে। প্রতিভা বসুর কাছাকাছি এলেই অনুভব করতাম একটা স্নেহের তরঙ্গ। আমার মা প্রতিভা বসুর রচনার ভক্ত ছিলেন, দু’জনে প্রায় একই বয়সি। আমি যে লাইব্রেরি থেকে মায়ের জন্য এনে দেওয়া প্রতিভা বসুর সবগুলি বইই পড়েছি, তা জেনে তিনি চমৎকৃত হয়েছিলেন। আর বুদ্ধদেব বসুর কাছে বসে তাঁর প্রতিটি কথা শোনার সময়ই আমি হয়ে উঠতাম শ্রুতিধর। যেন একটি শব্দও হারিয়ে না যায়, সব লিপিবদ্ধ হয়ে যেত মনে মনে।

*লেখকের বানানরীতির পরিবর্তন করা হয়নি।

Share this post

সবচেয়ে ভালো সময় কাটে লাইব্রেরিতে

www.porua.net
Share
Previous
Next
Comments
Top
New
Community

No posts

Ready for more?

© 2023 Riton Khan
Privacy ∙ Terms ∙ Collection notice
Start WritingGet the app
Substack is the home for great writing