নানা বিষয়ে বইয়ের সংগ্রহ শুধু আমাদের বাড়িতেই ছিল এমন না। বরিশালে অনেক ভদ্রলোকের বাড়িতেই প্রচুর সংখ্যক বই ছিল। কীর্তিপাশা ইস্কুলের হেডমাস্টার মহেন্দ্ৰকাকার ছোট ভাই মোক্তার মনাই দত্তর বাড়িতে অন্তত দু-তিন হাজার বই ছিল। এখানে উল্লেখযোগ্য—তখন Everyman-এর বইয়ের দাম ছিল প্রতি খণ্ড এক টাকা দু-আনা। Penguin বোধ হয় ১৯৩৬ বা ১৯৩৭ সনে প্রকাশ শুরু হয়। দাম প্রতি খণ্ড ছয় আনা। Everyman, Worlds Classics, Nelsons Classics ইত্যাদি সিরিজের প্রত্যেকটি বই মনাইকাকা কিনেছিলেন। উনি অল্প বয়সে বখে গিয়ে আই.এ. পাস করার পর লেখাপড়া ছেড়ে দেন। ফলে পেশায় তিনি উকিল না, মোক্তার। কিন্তু উন্নাসিক ইংরাজি দৈনিক স্টেটসম্যানে এই মফস্বলবাসী আই.এ. পাস মোক্তারের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হত। বিখ্যাত লড়াক্কু পণ্ডিত দেবপ্রসাদ ঘোষের বাড়িতে শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে কয়েক হাজার বই ছিল। শুনেছি ওঁদের বাড়িতে বইয়ের সংখ্যা আট-দশ হাজারের কম ছিল না। শুধু শেখার আনন্দে দেবপ্রসাদবাবু আঠারোটি ভাষা শিখেছিলেন। সায়েস্তাবাদের নবাবের বাড়িতে রীতিমতো লাইব্রেরি ছিল। মাস-মাইনে দিয়ে লাইব্রেরিয়ান রেখে সেসব বইয়ের তত্ত্বাবধান করাতেন। পরিচিত ভদ্রলোকদের নিখরচায় এইসব বই ধার দেওয়া হত। এ ছাড়াও ছিল পাবলিক লাইব্রেরি, শঙ্কর মঠ এবং রামকৃষ্ণ মঠের গ্রন্থসংগ্রহ, প্রতিটি স্কুলে এবং ব্রজমোহন কলেজে বেশ চমক লাগার মতো গ্রন্থসংগ্রহ। বরিশাল জিলা স্কুলের লাইব্রেরিতে মোগল যুগের ইতিহাস সম্পর্কীয় আকর গ্রন্থের যা-কিছু ইংরাজি অনুবাদে পাওয়া যায় তার সবই ছিল। একজন মাস্টারমশাই ক্লাসে ওই বইগুলি থেকে পড়ে শোনাতেন। মোগল ইতিহাস সম্বন্ধে আমার কৌতুহল ওইভাবেই শুরু হয়।
এইসব পুস্তক সংগ্রহ আর গ্রন্থাগারের কথা তুললাম একটি কারণে। উনিশ শতকে যে-পশ্চিমি শিক্ষার শুরু হয়—বাঙালিজীবনে তার একটি মহৎ দান বিশ্বসংস্কৃতি সম্বন্ধে অন্তহীন কৌতূহল। ১৯১৭ সনে স্যাডলার কমিশন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে মন্তব্য করেন যে, শিক্ষিত বাঙালি যুবক শুধু নিজের দেশে কী হচ্ছে জেনে তুষ্ট না, লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্কে জ্ঞানের জগতে কী হচ্ছে সে খবর জানার জন্য তার দুরন্ত আগ্রহ। বরিশালের শিক্ষিত মহলে এই প্রবণতা স্পষ্টতই নজরে আসত। টাউন হলের পাশেই কালা ভাইয়ের দোকানে নানা বিষয়ের বই পাওয়া যেত। একটা শেলফ্ জুড়ে ফরাসি বই ছিল। ওই ভাষাটি ভালভাবে পড়তে পারেন, এ রকম বেশ কয়েকজন লোক ছিলেন। এঁদের একজনের সঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়ার সময় ঘনিষ্ঠতার সুযোগ পাই। তিনি বঙ্কিম রায়চৌধুরী। জন্ম থেকে প্রায় দৃষ্টিহীন মানুষটি স্থানীয় গার্লস স্কুলে এবং পরে ব্রজমোহন কলেজে পড়াতেন। জীবনের অধিকাংশ কেটেছে পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর টাকা মাইনের চাকরিতে। ওই সামান্য আয়ে উনি রীতিমতো চমকপ্রদ লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন।
লেখকের বানানরীতির পরিবর্তন করা হয়নি।