গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সেরা ৮টি বই
মার্কেস উপন্যাসের কাহিনী এবং বাস্তবতার মিশ্রণ ঘটিয়ে লাতিন আমেরিকার বিশাল বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
পাঠকদের কাছে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সবিশেষ পরিচিত। তাঁর সম্পর্কে নতুন করে বলা বাহুল্যমাত্র। যদিও মার্কেসকে নিয়ে পাঠকদের কৌতূহলের শেষ নেই। সাংবাদিকতার দায়িত্ব সামলে মার্কেস যে পরিমাণের সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তা সত্যি অভাবনীয়। পৃথিবীর যে-কোনও লেখকের কাছে তা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। মার্কেসের সেরা ৮টি বই, যা প্রতি মার্কেসপ্রেমীদের অবশ্যপাঠ্য বলে আমার মনে হয়।
“One Hundred Years of Solitude” (1967)
উপন্যাসের শুরুতেই ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড়িয়ে গুলির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে কর্নেলের মনে হয় অনেক বছর আগে বাবার সঙ্গে প্রথম বরফ আবিষ্কারের কথা। মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ পেতে চলেছেন তিনি, এরকম একসময়ে বরফ আবিষ্কারের কথাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। অনেক পরে মার্কেস আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, জীবনভর একটি কাহিনিই লিখেছেন তিনি, আর তা হলো একাকিত্বের কাহিনি এবং এমন একাকিত্ব মানুষের আসে কেবল ভালোবাসাহীনতা থেকে। বুয়েন্দিয়া পরিবারে একাকিত্ব ছিল, কেননা সেখানে ছিল ভালোবাসাহীনতা। পুরো বইয়ে, মার্কেস নিজেই বলেছেন, গোটা একশ বছরের নিঃসঙ্গতার আখ্যানে একমাত্র বুয়েন্দিয়া হলেন টিকিদার অরেলিয়ানো, যাঁর মধ্যে ভালোবাসার রূপ-রস খুঁজে পাওয়া যায়। যেন তিনি আমাদের আসলে বলতে থাকেন নিঃসঙ্গতাকে উজিয়ে ভালোবাসার জন্মকথা, মানুষের বাসভূমি পত্তনের ইতিকথা। বরফ আবিষ্কারের কথা মনে হওয়ার পর আমাদের আরো জানা হয়ে যায়, কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার বাবা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছিলেন প্রচন্ড উদ্যমী আর অভিযানপ্রিয় মানুষ, বারবার বিজ্ঞানের সুযোগ-সুবিধাগুলো ভোগ করার প্রয়াসে সে লোকজনকে নিয়ে বারবার বসতি স্থাপন করে বিভিন্ন এলাকায়; কিন্তু তার স্ত্রী উরসুলা একসময় তার এই গোপন স্বভাব বুঝে ফেলে এবং মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করে কারো ঠাঁইনড়া মতিগতিকে প্রশ্রয় না-দিতে। মানুষজনের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে শেষমেশ হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া কর্কশ কণ্ঠে ঘোষণা করে, তাহলে তারা একাই যাবে অন্য কোনোখানে। উরসুলা তার জন্ম নেওয়া ছেলেটির কথা স্মরণ করিয়ে দিলে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া জানান দেয়, তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন এখনো এখানে মারা যায়নি এবং মাটির তলায় আপনজনদের কেউ ঠাঁই না নেওয়া পর্যন্ত ওই জায়গার মাটির ওপর কারো অধিকার জন্মায় না। তখন ধীরস্থির কণ্ঠে উরসুলা জানিয়ে দেয়, তাহলে সে নিজেই মরতে রাজি, তাদের বাদবাকি সবার থিতু হওয়ার স্বার্থে।
“Love in the Time of Cholera” (1985)
উপন্যাসটির তিন মুখ্য চরিত্র ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো, ফ্লোরন্টিনো আরিজা ও ফারমিনা ডাজার জীবন পঞ্চাশ বছর ধরে পরস্পরের জীবনের সঙ্গে নানা গ্রন্থিতে জড়িয়ে যায়, রাগ-অনুরাগ ও দ্বন্দ্বময় আবেগ অনুভূতির টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে তাদের সম্পর্ক যে পরিণতির দিকে অগ্রসর হয় তা পাঠককে একই সঙ্গে আনন্দিত, বিস্মিত ও শিহরিত করে। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ও ফারমিনা ডাজার ক্ষেত্রে। ফ্লোরেন্টিনো যখন ফারমিনার প্রবল অপ্রতিরোধ্য প্রেমে পড়ে তখন প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ উভয়েই ছিল অল্পবয়েসী তরুণ-তরুণী। উদ্ভিন্নযৌবনা ফারমিনা ডাজার বিয়ে হয়ে যায় শহরের সব চাইতে কাম্য প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী অভিজাত বংশের উচ্চশিক্ষিত সুরুচিসম্পন্ন বিত্তশালী সুদর্শন ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর সঙ্গে। এই বিয়ে হয় সুখের, কিন্তু পঞ্চাশ বছরের সুখী দাম্পত্য জীবনের শেষে ডাক্তার যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন ফারমিনার পূর্ব-প্রেমিক ফ্লোরেন্টিনো, যে কখনোই ফারমিনাকে ভুলতে পারেনি, তার কাছে আবার তার আবেদন নিয়ে উপস্থিত হয় এবং এক পর্যায়ে, উভয়েই বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়া সত্ত্বেও, তাদের চমকপ্রদ মিলন ঘটে নদীবক্ষে চলাচল এক নৌযানে। মার্কেস যেভাবে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তার মধ্যে ডিটেলের যে অবিশ্বাস্য সম্ভার যুক্ত করেছেন তা পাঠককে মুগ্ধ করে । চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে লেখকের দক্ষতা ঈর্ষণীয়। প্রধান তিন চরিত্র ছাড়াও তিনি এই উপন্যাসে এমন অনেকগুলি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যাদের ভোলা যায় না, যেমন ফারমিনার বাবা লোরেঞ্জো ডাজা, তারা পিসি এস্কোলাস্টিকা ও খালাতো বোন হিল্ডাব্রান্ডা, ফ্লোরেন্টিনোর মা ট্রান্সিটো আরিজা, তার শয্যাসঙ্গিনী বিধবা নাজারাত, সারা নরিয়েগা, আসেনসিনো সান্তাদারা, তার বন্ধু ও সহকর্মী লিওনা কাসিয়ানি, টেলিগ্রাফ অফিসে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও শিক্ষক লোটারিও থুগুট এবং এমনি আরো কয়েকজন। এ উপন্যাসে আমরা অনায়াসে এক কাহিনী থেকে আরেক কাহিনীতে প্রবেশ করি এবং সব কিছু মিলে যে মোজেইক শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয় তা আমাদের বাইজানটাইন যুগের শিল্পকর্মের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এই প্রেমের উপন্যাসে কলেরার প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে, বিভিন্ন কাল ও ঘটনাপর্বে। তরুণ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রেমে পড়ে অসুস্থ হয়, তার পেটের পীড়া দেখা দেয়, চোখের নিচে কালি পড়ে, গলা শুকিয়ে যায়, বমি হতে থাকে, মায়ের ভয় হয় যে ছেলের বুঝি কলেরা হয়েছে। ফ্লোরেন্টিনোর ধর্মপিতা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সব কিছু দেখে নানা প্রশ্ন করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হন, ওর কলেরা হয়নি, সে প্রেমরোগে আক্রান্ত হয়েছে, দুটোর উপসর্গই এক রকম।
শহরে একবার কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটলে ফারমিনা ডাজা একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার বাবার ভয় হল মেয়ে বোধ হয় কলেরা আক্রান্ত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো ফারমিনাদের বাড়ি যায়, ফারমিনাকে পরীক্ষা করে, তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তবে ফারমিনার কলেরা হয়নি, সাধারণ অসুখ হয়েছিল।
ওই সময়ে ক্যারিবীয় অঞ্চলে মাঝে মাঝেই মহামারী আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়তো। উপন্যাসের নানা পর্বে আমরা এ প্রসঙ্গ পাই। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর বাবা তাঁর সময়ে একটা সাংঘাতিক কলেরা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কালে আক্রান্ত রোগীদের যেভাবে চিকিৎসা ও সেবাদান করেন তা ছিল তুলনাহীন। তিনিও ডাক্তার ছিলেন। তিনি কাজ করেন শহরের সঙ্গতিহীন কৃষ্ণাঙ্গ রোগীদের মধ্যে, এক পর্যায়ে রোগ তাকেও আক্রমণ করে এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন ভয়শূন্য অন্তরে, কলেরার শিকার হয়ে। আমাদের মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ উপন্যাসে শচীনের জ্যাঠামশাই জগমোহনের কথা।
প্রেম ও কলেরার একেবারে শেষ পর্বে উপন্যাসটির সমাপ্তি লগ্নেও আমরা কলেরার প্রসঙ্গ পাই, তবে মার্কেস এখানে নিয়ে এসেছেন জাদুবাস্তবতার আবহ। যৌবনোত্তীর্ণ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ও ফারমিনা ডাজা যখন জীবনের গোধূলিলগ্নে নদীর বুকে নৌযানে ভ্রমণ করছে তখন খবর পাওয়া গেল যে নদীতীরবর্তী অঞ্চলে কলেরা দেখা দিয়েছে, কয়েকটি মৃতদেহকেও জলে ভাসতে দেখা গেল। প্রেমিক-প্রেমিকা এই সুযোগ কাজে লাগাবার সিদ্ধান্ত নিলো। তারা তাদের জাহাজে বিপদপতাকা উড়িয়ে দিলো, এই জাহাজে কলেরা আক্রান্ত রোগী রয়েছে, কাজেই তারা কোনো বন্দরে থামতে পারবে না। তাদের জাহাজ ভ্রমণসূচির যাত্রাশুরু ও শেষ গন্তব্য স্থানের মধ্যে যাওয়া-আসা করতে থাকলো। জাহাজের কাপ্তান ব্যাপারটার মধ্যে একটা স্নিগ্ধ কৌতুকের উপাদান পেলেও একটু বিব্রতও বোধ করেন, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তো কোম্পানির মালিক, তাঁর নির্দেশ তো কাপ্তানকে মানতেই হবে। কাপ্তান যখন জিজ্ঞাসা করলেন, তো, কতকাল নদীবক্ষে আমরা এই রকম যাওয়া-আসা করবো, তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, তুলনারহিত প্রেমিক, উত্তরে জানাল অনন্তকাল।
আরো কয়েকটি কথা বলতে হয়। তা হচ্ছে মার্কেসের অসামান্য কৌতুকরসবোধ, সচেতনভাবে অত্যুক্তি ও আতিশয্যকে প্রশ্রয় দান, কাহিনীর মধ্যে যৌনতার অনুষঙ্গ যা কখনো কখনো প্রায় পর্নোগ্রাফির কান ঘেঁষে চলে যায়। একটা উপকাহিনীতে বারবনিতাদের প্রসঙ্গ আছে, মার্কেস ওই পর্বটি এমনভাবে উপস্থিত করেছেন যে তার মধ্যে অশ্লীলতার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া লাগে না।
'প্রেম ও কলেরা' একটি অসামান্য প্রেমের উপাখ্যান, প্রাথমিক পর্বে একটি প্রত্যাখ্যাত প্রেমের অর্ধশতাব্দী পরে তার সাফল্যজনক চরিতার্থতার কাহিনী, কিন্তু এই বর্ণনা উপন্যাসটির বর্ণাঢ্যতার, প্রাণবন্ততার, বহুমাত্রিকতার সামান্যই প্রকাশ করে। বিষয়বস্তু, ভাষার কারুকাজ, চরিত্র চিত্রণ ও বাস্তবতার সঙ্গে রোমান্টিকতার মিশেল 'প্রেম ও কলেরা'-কে একটা আকর্ষণীয় অনন্যতা দিয়েছে আর সেটাই এ উপন্যাসের দৈর্ঘ্য ও জটিলতা সত্ত্বেও আমাকে তার অনুবাদে প্রবৃত্ত করেছে।
“Strange Pilgrims” (1992)
এখনকার পৃথিবীতে লেখকদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস্ অবশ্য বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছেন। গল্পগুলি আকর্ষণীয় একটি বিশেষ কারণে। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত উপন্যাস 'নিঃসঙ্গতার এক শতাব্দীর'র লেখক হিসেবেই মার্কেস সর্বশেষ পরিচিত এবং তাঁর নাম শুনলেই মনে পড়ে ম্যাজিক রিয়েলিজমের কথা। কিন্তু সেই বিশিষ্ট শিল্প আঙ্গিক মার্কেসের অনেক গল্পেই অনুপস্থিত। এই ছোটগল্পগুলির রচযিতা যেন অন্য এক মার্কেস্। বড়জোর তাঁর কয়েকটি গল্পকে বলা যায় ম্যাজিক রিয়েলিজ্ম আঙ্গিকের আঁতুড় ঘর। অন্যান্য গল্পগুলিতে টানা বর্ণনা রীতিই অনুসৃত হয়েছে।
“The General in His Labyrinth” (1989)
জেনারেল সিমন বলিভার, দক্ষিণ আমেরিকার পাঁচটি দেশের ‘মুক্তিদাতা’ ম্যাগডালেনা নদীর ভাটিতে বিষাদময় শেষ ভ্রমণটির সময় পুনর্দশন করেছেন নদী তীরের শহর গুলো এবং হাতড়ে ফিরেছেন তার জীবনের সাফল্য, অনুরাগ ,উৎসাহ, ঘৃণা ও ক্রোধের তীব্র অনুভূতি এবং বিশ্বাসঘাতকতার স্মৃতিগুলো। অপরিমেয় মনোমুগ্ধকর , অত্যাশ্চর্যরুপে সফল যুদ্ধ, প্রেম এবং রাজনীতিতে; তখনও পর্যন্ত তিনি এতটাই উৎসাহ আর দক্ষতার সাথে নাচছিলেন যে প্রত্যক্ষদর্শীরা বিশ্বাস করতে পারছিলনা তিনি অসুস্থ।তিনিই ছিলেন যে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক সেটার বহ্নিমান স্মৃতি এবং তার মহদেশীয় একতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নটি সুকৌশলে এড়িয়ে চলছিল তাকে, কত বেশি অর্জন আর হারানোর যায় এক জীবনে - তিনি হচ্ছেন তারই চলমান দৃষ্টান্ত।
“Chronicle of a Death Foretold” (1981)
আজকের ইউরোপে আধুনিক সাহিত্যের ধারণা হচ্ছে বিরক্তি আর ঘৃণা, আশাভঙ্গ, অযৌক্তিকতা, ধ্বংস, ক্ষয় আর বিনাশ, বৈরাগ্য ও বিচ্ছিন্নতা। আসলে ওদের আশাবাদী হবার যেমন কোনো সুযোগও নেই, তেমনই কারণও নেই । সেদিক থেকে দেখতে গেলে বরং আমাদের সমস্ত ভবিষ্যৎ আমাদের সামনে পড়ে রয়েছে । সবেমাত্র আমাদের আইডেনটিটির সম্মুখীন হয়েছি ।
উপন্যাসও যে পুরনো বাস্তবতাকে নতুনে রূপান্তরিত করার একটা রচনাকৌশল সেটা মার্কেস তাঁর আগাম জানান-দেয়া মৃত্যুর কালপঞ্জিতে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে আমাদের হয়তো অনেককাল অপেক্ষা করতে হতো । কালপঞ্জিতে কলাম্বিয়ার অভ্যন্তরের বদ্ধজলে পরিভ্রমণ করেছেন মার্কেস আশ্চর্য নৈপুণ্যের সঙ্গে । যে ভূখণ্ডের সঙ্গে মার্কেসের নিয়মিত পাঠকরা খুবই সুপরিচিত ।
ছদ্মনৈতিকতা ও মর্যাদাবোধের রহস্যময় ধারায়, এই গুপ্ত চক্রান্তের কাহিনীপরম্পরা ও আতঙ্ক একটি ছোট ও ঘনবদ্ধ বসতিকে কতটা জটিল করে তুলতে পারে তার চমকপ্রদ ও জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত কালপঞ্জির প্রতিটি ছত্রে দেখবার মতো। অবশ্য কাহিনীর পুনর্নির্মাণে মার্কেসের বিস্ময়কর ক্ষমতা এর আগে আমরা ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর'এও দেখেছি। ‘একটি পূর্বঘোষিত মৃত্যুর কালপঞ্জি'ও সেরকমই আর একটি প্রগাঢ় প্রাণবন্ত নাটক যার মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না এমন একটা সহজ বৈশিষ্ট্য এত স্বচ্ছন্দ, এত সুসংবদ্ধ ও সুসংহতভাবে ফুটে ওঠে যে, লক্ষ্য করলে অবাক হতে হয় । সাহিত্যে মৃত্যুযন্ত্রণা সচরাচর একটা সমাজের ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা, অবাস্তব বনাম বাস্তব এই দুই সংঘাতপূর্ণ শক্তির মধ্যে দিয়ে উন্মোচিত হয়। কালপঞ্জি একবার পড়বার পরই ফুরিয়ে যাওয়ার বই নয়। প্রতি পঠনেই পাঠক এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন । নতুন নতুন আবিষ্কারে, নতুন তাৎপর্যে, নতুন বিস্তারে যেমন বিস্ময়বিমুগ্ধ হবেন তেমনই নব নব জটের খেলায় কাহিনীর নাটকীয় মোচড়ে হয়ে উঠবেন রুদ্ধশ্বাস! আর এখানেই কালপঞ্জির প্রকৃত শক্তি। এক সময় নিজেকে যিনি তৃতীয় বিশ্বের একজন তৃতীয় শ্রেণীর ফকনার হওয়ার আশঙ্কায় ভয়ে ভয়ে থাকতেন তিনিই যে পরবর্তীকালে জাদুবাস্তবতার নেতৃস্থানীয় হিসেবে বিবেচিত হবেন কে জানত!
“Memories of My Melancholy Whores” (2004)
১৯৫০-এর দশকের কলম্বিয়ার বার্রানকিয়ার প্রেক্ষাপটে লেখা ১০৯ পৃষ্ঠায় আমার দুঃখভারাক্রান্ত বেশ্যাদের স্মৃতিকথা উপন্যাসের আখ্যানকারী ও মূল চরিত্র তাঁর সঙ্গে রাত কাটানো পাঁচশ জনেরও অধিক রমণীর প্রত্যেককে পয়সা দিয়ে ভাড়া করেছেন যদিও, কিন্তু উপন্যাসের বেশ্যাদের নিয়ে নয়। এর মূলে আছে প্রেম। কিপ্টে লোকটা জীবনের নব্বইতম জন্মদিনে হঠাৎ নিজেকে একটি অন্য রকমের রাত উপহার দিতে যাওয়ার বায়নায় তাঁর বহুদিনের পরিচিত কিন্তু অনেক বছর দেখা-সাক্ষাৎ নেই, এ রকম এ বেশ্যালয়ের সর্দারনির বহু আগে দেওয়া অসংলগ্ন প্রস্তাবের কথা ভেবে তাকে ফোন করে বলে, ‘আমার একটা কুমারী মেয়ে দরকার এবং সেটা আজ রাতেই।’ ব্যস! সবকিছু পাল্টে গেল। যে বয়সে বেশির ভাগ মানুষ আর দুনিয়ায় বেঁচে থাকে না, সেই বয়সে তাঁর জীবন এক নতুন মোড় নেয়। প্রেম।
“The Scandal of the Century” (2019)
গ্যাবোকে সাংবাদিক হিসেবে প্রকাশ করে নিবন্ধের সংকলনটি। লেখক জোন লি অ্যান্ডারসন 1950 থেকে 1984 সাল পর্যন্ত 50 টি সাংবাদিকতামূলক রচনা থেকে এই বৈচিত্র্যময় লেখাগুলি নির্বাচন করেছেন। সাংবাদিকতা ছিল গার্সিয়া মার্কেসের "প্রথম সত্যিকারের ভালবাসা"। মার্কেস (1927-2014) এটিকে "বিশ্বের সেরা পেশা" বলে অভিহিত করেছেন। নিবন্ধগুলির মধ্যে অনেকগুলি রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়গুলি মোকাবেলা করে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিউবার অবরোধ, নিকারাগুয়াতে স্যান্ডিনিস্টা হামলা, মহিলাদের আন্তর্জাতিক পাচার, তার প্রিয় ম্যাগডালেনা নদীর মৃত্যু দূষণ এবং বন নিধন থেকে, হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ পর্যন্ত। গার্সিয়া মার্কেস স্বীকার করেন যে একজন লেখকের "শুধুমাত্র কর্তব্য হলো ভালভাবে লেখা"।
“The Autumn of the Patriarch” (1975)
কে এই গোত্রপিতা বা একনায়ক? ক্যারিবীয় সাগরের উপকূলে এক দরিদ্র দেশের পাহাড়ি এলাকার এক যাযাবর পাখিওয়ালী বেনদিসিয়ো আলভারাদোর গর্ভের বিবাহ বহির্ভূত অবৈধ সন্তান যিনি কখনো স্কুলে যেতে পারেননি পয়সার অভাবে তিনিই কালক্রমে হয়ে ওঠেন সে দেশের একনায়ক। রাষ্ট্রের শাসনভার নেবার সময়েই এক রেড ইন্ডিয়ান ভবিষ্যদ্বগণনাকারীণী বৃদ্ধা তাঁকে বলেছিলেন ১০৭ হতে ২৩২ বছর পর্যন্ত তিনি বাঁচবেন । তাইই হয়। জেনারেল অনন্তকাল অবধি বেঁচে চলেন আর শাসনকাজ অব্যাহত রাখেন। তিনি অসুখের নিরাময়কারী, ভূমিকম্প, বন্যা ও মহামারীর সংশোধনকর্তা আর তাঁর হাত থেকেই রাষ্ট্রের যত অন্ধ, খোঁড়া ও কুষ্ঠরোগীরা সুস্থ হবার জন্য লবণ নেয় তাঁর হারেমে এক হাজার উপপত্নী জেনারেলের ঔরসে তাদের সাড়ে সাতমাস বয়সী দেখতে বামুন সন্তানদের নিয়ে বাস করে যেহেতু জেনারেলের কোন সন্তানই স্বাভাবিক মানব সন্তানের চেহারা ও বৃদ্ধি নিয়ে জন্মায় না।