তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’ নিয়ে কবি জাহিদ সোহাগের পোস্টটা দেখে মনে পড়ল যে, জীবনে বহু উপন্যাস বা বই আমি জেদের বশবর্তী হয়ে পড়েছি। এখন এটা আমার কাছে আশ্চর্যের বিষয় লাগে যে, সেসব বইয়ের বেশিরভাগই পড়েছি বাসে। সাভার থেকে বাংলামটর যাতায়াতের সময়। ‘ওয়ার অ্যান্ড পীস’ ছিল আমার জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। একেকবার মনে হতো, ধুর, এই জিনিস আর পড়বই না! এত ডিটেইল, এত ডিটেইল! কাঁহাতক ধৈর্য রাখা যায়! পরক্ষণে নিজেকেই নিজে বলতাম, ‘তুমি হেরে যাচ্ছ নোমান।’ আর অমনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসতাম। আমি হারব কেন? তলস্তয় এত বড় উপন্যাস লিখতে পারলে আমি পড়তে পারব না? তা ছাড়া আমি উপন্যাস লিখব, আমার পূর্বজরা কী লিখেছেন, তা আমি পড়ব না? চার খণ্ড পড়ে শেষ করে তলস্তয়কে হারিয়ে দিলাম।
দ্বিতীয় পরীক্ষা ছিল ফেরদৌসির ‘শাহনামা’। রুস্তম কর্তৃক সোহরাব নিহত হওয়ার পর রুস্তমের শোক জারিত হয়েছিল আমার মধ্যে। এতটাই হাহাকার জেগেছিল যে, মহাকাব্যটি আর না পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। নিয়েছিলাম এই জন্য যে, এমন বিষাদ-করুণ দৃশ্য এই কাব্যে আর যদি না পাই! হাহাকারটা থেকে যাক। শাহনামা আমার কাছে এই হাহাকার হয়েই থাকুক। কিন্তু পরে ভাবলাম, এই জিনিস না পড়েই মরে যাব? জীবনের তবে স্বার্থকতা কোথায়? তখন আমি এক মাস বেকার ছিলাম। ওই মাসটা কাজে লাগালাম। টানা এক মাস ‘শাহনামা’র মধ্যেই ডুবে ছিলাম। পড়ার পর মনে হয়েছিল আমি একটা বিশাল সাম্রাজ্য ভ্রমণ করে দেশে ফিরলাম।
আর মিখাইল শোলোখভের ‘প্রশান্ত দন’। বাপ রে! চার খণ্ডের এই উপন্যাসটা জোগাড় করতেই আমার বারোটা বেজে গিয়েছিল। ফটোকপি সংগ্রহ করেছিলাম। সে আরেক অভিজ্ঞতা। সেই কারণেই উপন্যাসটার প্রতি আমার জেদ এতটাই চেপেছিল যে, সিদ্ধান্ত নিলাম এটা বাংলাদেশ থেকে বই আকারে না ছেপে পড়বই না। মনে হয়েছিল, আমার মতো অনেক পাঠক নিশ্চয়ই এটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে ছাপলে পাঠকরা উপকৃত হবেন, ভালো একটা বই পড়ার সুযোগ পাবেন। রোদেলা প্রকাশনীর রিয়াজ খানকে বললাম, চার খণ্ড একসাথে ছেপে দেন, দায় আমার, পরে যা হওয়ার হবে। রিয়াজ খান ছেপে দিলেন, অরুণ সোমের নামে, অনুমতি ছাড়াই। পাঁচ শ কপি ফুরাতে এক বছর লাগল। তবু ফুরাল। রক্ষে। নইলে রিয়াজ খান জীবনে আর আমার অনুরোধ রাখতেন কিনা সন্দেহ!
এটা আমার জীবনের একটি ‘অপকর্ম’। ‘অপকর্ম’ এই জন্য যে, বইটি ছাপার আগে অনুবাদকের অনুমতি নেয়া হয়নি। কিন্তু আমার তরুণ মনে তখন একটা যুক্তি তৈরি হয়েছিল যে, কলকাতার কত বইই তো অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশে ছাপা হয়। নীলক্ষেতের অসংখ্য অনুবাদই অনুমতিহীন। ডেল কার্নেগি, স্টিফেন হকিংস, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, সুনীল প্রমুখের বিস্তর বই অনুমতি ছাড়া ছেপে বিক্রি হচ্ছে। ‘প্রশান্ত দন’ও হোক। ভালো বই, হতে অসুবিধা কী? আমি কোথায় অনুমতি নিতে যাব? কলকাতায় কখনো যাইনি, অরুণ সোমের সাথে পরিচয় নাই, তাঁর অনুমতি কি পাব? তার চেয়ে বরং ছেপে দিই। ছেপে দেওয়ার পর অবশ্য একদল অগ্রসর পাঠকের প্রচুর নিন্দার শিকার হয়েছিলাম। ওই নিন্দাটা আমার প্রাপ্য ছিল। কেন আমি অনুমতি ছাড়া এটা ছাপার দায় নিলাম? এখন হলে অবশ্য এমন দুঃসাহসটি করতাম না। তারুণ্যের এই 'অপকর্মটি'র জন্য অরুণ সোম নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করবেন। তিনি মহান, ক্ষমাশীল। আমি বিনীত ক্ষমাপ্রার্থী।
আরেকটা বই হচ্ছে দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপুরাণ’। এক বুড়িমার ‘প্যাঁচাল’ চলছে তো চলছেই, শেষই হয় না। আমিও খুঁটি গেঁড়ে বসলাম। দেখি দেবেশ রায় কত ‘প্যাঁচাল’ পাড়তে পারেন। শেষ না করে ছাড়বই না। উপন্যাসটি শেষ করে নিজেকে নিজে অভিনন্দন জানালাম। ঢাকায় একবার যখন দেবেশ রায়ের সঙ্গে দেখা হলো, তাকে বলেছিলাম উপন্যাসটি পাঠের অভিজ্ঞতা। তিনি হাসলেন। ভেবেছিলাম তিনি বলবেন, ‘তোমার ধৈর্য্য আছে বটে।’ কিন্তু না, তিনি আমাকে মারহাবা দিলেন না। মনে মনে বললাম, আমি লঙ্কা জয় করে ফেললাম, অথচ আপনি আমাকে একটা ধন্যবাদও দিলেন না!
গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ এতই স্লো মনে হচ্ছিল যে, নিজেকে মনে হচ্ছিল একটা মালগাড়ি, যে গাড়ি স্টেশনে স্টেশনে থামে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা থেমে থাকে, আন্তঃনগর এক্সপ্রেসগুলোকে সাইড দেয়। অন্য পাঠকের কাছে উপন্যাসটি ধীর গতির না-ও লাগতে পারে, আমার কাছে লেগেছিল। আমি ধীরেই এগুচ্ছিলাম। কুড়ি-পঁচিশ পাতা পড়ে রেখে দিতাম। অন্য কাজ করতাম। আবার পড়তাম। এভাবে একদিন এই মালগাড়ি গন্তব্যে পৌঁছল। শেষ হওয়ার পর একটা দীর্ঘ পাঠঅভিজ্ঞতা লিখেছিলাম। বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করব বলে লেখাটা খুঁজছিলাম। পরে আর পাইনি। চিরতরে হারিয়ে গেছে।
আর ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’। উপন্যাসটি আমি সম্মোহিতের মতো পড়েছিলাম। জাঁ ভলজাকে গ্রেপ্তারে দিনের পর দিন চেষ্টা করে পুলিশ। ধরতে পারে না। একদিন হাতে নাতে ধরল। কিন্তু পুলিশ অফিসার তাকে গ্রেপ্তার করার বদলে আত্মহত্যা করে বসল। এই দৃশ্য আমাকে মুষঢ়ে দিয়েছিল, নাড়িয়ে দিয়েছিল। এও কি সম্ভব! এমনও কি হতে পারে! তখন কোনো মেয়েকে দেখলেই তার মধ্যে আমি কসেত্তেকে খুঁজতাম। ভাবতাম, এই মেয়েটি কি কসেত্তের মতো? সেই কসেত্তে, জাঁ ভলজা যাকে কন্যাস্নেহে লালন-পালন করেছিল। জাঁ ভলজা চরিত্রটি কখনো আমার স্মৃতি থেকে যাবে না। এক মহান চরিত্র হয়ে আজীবন সঙ্গে থাকবে।
রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, অডিসির পাঠঅভিজ্ঞতা তো অন্যরকম। সেই অভিজ্ঞতা লিখতে গেলে একটি দীর্ঘ গদ্য হয়ে যাবে। হয়ত লিখব অন্য কোনো সময়। আমার পাঠক জীবনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল দুটি বই : রামায়ণ ও মহাভারত। এই দুটি বই আমাকে ধৈর্য্য শিখিয়েছে, পাঠ কীভাবে করতে হয় শিখিয়েছে। খুলে দিয়েছে ভারতবর্ষের দুটি সিংহ দুয়ার। বই দুটি আমাকে টেনে নিয়ে গেছে ভারতীয় পুরাণের আরো গভীরে। করে তুলেছে অনুসন্ধিৎসু। সে দীর্ঘ কাহিনি।
এরকম কত কত বই যে জেদের বশে পড়া! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ওরহান পামুকের ‘তুষার; ‘ইস্তাম্বুল : একটি শহরের স্মৃতিচারণ’, ‘দ্য নিউ লাইফ’, ‘সফেদ দুর্গ’ ইত্যাদি বই আনন্দের সঙ্গে পড়ে ফেলা হলেও এখনো পর্যন্ত ‘মাই নেম ইজ রেড’ পড়ে উঠতে পারিনি। অন্তত আটবার চেষ্টা করেছি। শেষবার বায়াত্তর পৃষ্ঠা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। পরে থেমে গেল। আর পড়া হয়নি। প্রায়ই ভাবি এটা পড়ে শেষ করব। কিন্তু জেদটা জাগিয়ে তুলতে পারি না। জেদটা জাগিয়ে তুলতে পারলে ঠিক পড়া হয়ে যাবে।
এসব বড় বড় বই পড়ে আমার একটা লাভ হয়েছে। শিখেছি কীভাবে উপন্যাসের বিস্তার ঘটাতে হয়, শিখেছি কীভাবে দম ধরে রাখতে হয়। এই বিশাল বিশাল বইগুলো না পড়লে হয়ত দম হারাতাম। হয়ত লেখালেখি আমার কাছে অর্থহীন মনে হতো। পড়ার কারণে মনে হয় না। কখনেই মনে হবে না।