না পাঠকের হ্যাঁ পাঠক হয়ে ওঠা
শুভজিৎ সরকার | আমার সাথে এই বই পৃথিবীর পরিচয় মাত্র বছর পাঁচ ছয়ের। সেই যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন দাদার কলেজের বই পত্রের পাশেই একদিন আবিষ্কার করে ফেলি মহাশ্বেতা দেবীর নাম। স্কুলের টিফিনে আর না ভালো লাগ
আমার বই পরিচয় এর কথা লিখতে গেলেই, আমাকে হয়ত ফিরে চলে যেতে হবে আমার সেইসব ছোটোবেলার দিন গুলোয়, যখন কেউ আমায় শুকতারা, আনন্দমেলা বা কিশোরভারতী পড়ায়নি। যখন নামই শুনিনি আরন্যদেব বা টিনটিনের। অথবা পাঠ্য বইএর পর বাকি বই গুলো যখন পাতা উল্টেই রেখে দিতাম ভয়ে। যদি আমাকে সেসব পড়তে হয় তবে তো ঝক্কি। স্কুলের পড়াতে মন বসাতে পারিনি কোনো দিন তারপর সেসব মোটা বই গুলোয় যতই ছবি থাকুক তার থেকে অক্ষর সংখ্যা বেশি। তাই বেজায় ভয় পেতাম। তবে সেই বয়সে আমার এই ভয় কাটিয়ে ওঠার গুপ্তমন্ত্র জোর করে আমায় কখনো কেউ দেয়নি। মনে মনে ভাবছি, সেই জন্যেই হয়তো ক্লাস নাইনে চুপি চুপি গিয়ে মায়ের নাম করে লাইব্রেরির সদস্য হয়েছিলাম। সে জন্যেই হয়ত অত বড়ো বয়সে পড়েছি ম্যাক্সিম গোর্কি আর অত ছোটো বয়সেই পড়ে ফেলেছিলাম বুদ্ধদেব গুহ।
আমার সাথে এই বই পৃথিবীর পরিচয় মাত্র বছর পাঁচ ছয়ের। সেই যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন দাদার কলেজের বই পত্রের পাশেই একদিন আবিষ্কার করে ফেলি মহাশ্বেতা দেবীর নাম। স্কুলের টিফিনে আর না ভালো লাগা ক্লাসের ফাঁকে চলত আমার একটু একটু করে অরণ্যের অধিকার পড়া। শুরু হলো আমার পরিচয় বই পৃথিবীর সাথে। এই পৃথিবীর দরজা আসলে একটা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো, যেখানে চাওয়ার শেষ থাকে না। না-চাওয়া আমার বই নেশা কে অবশ্য বাড়িয়ে দিয়েছিল আমার ক্লাস নাইনেরই এক বান্ধবী। যার যেচে ধার দেওয়া বুদ্ধদেব গুহ পড়ে আমার রিডিং হ্যাবিট বেড়েছে।
তবে এই সব কথা সবই একটা সময়ের, যেখানে আমি আর বই। সেই যেদিন কোচিং ফেরতা পথে মুক্তোর মতো খুঁজে পেয়েছিলাম পাড়ার ক্লাবের ছোট্ট লাইব্রেরি। তারপর প্রতি রোববার সমস্ত কাজ সরিয়ে অপেক্ষা করি নতুন বই ইস্যু করার। এর মধ্যে একটা রোমাঞ্চ থাকে, পুরনো ধুলো ঝাড়া, উইয়ে খাওয়া একটা আদিম গন্ধ থাকে এসবে। সেই সব ঘাটতে ঘাটতেই তো আজও উল্টাই রাবার স্ট্যাম্প এর কালির ছাপে লেখা পাতা না-মোড়ার নিদান। ভাবতেও অবাক লাগে এভাবেই একদিন হাতে পেয়ে গিয়েছিলাম অপরাজিতর প্রথম সংস্করণ।
ছোট্ট লাইব্রেরি থেকে আজ বড়ো লাইব্রেরিতে গেছি। আজ লেখকের নাম দেখে আর রেজিস্টার খাতা না খুললেও চলে, সামনেই থাকে ডিজিটাল ক্যাটালগ। তবুও প্রায় রোববার ফেরৎ যাই পাড়ার লাইব্রেরিয়ান এর সাথে দেখা করতে। সমরেশ বসু পড়তে পড়তে কোথায় যদি আটকে যাই, উনি তখন আমার বই পৃথিবীর সিধু জ্যাঠা হয়ে যান।
এখনও যেহেতু কলেজে পড়ি তাই বই কেনায় অনেক হিসেবে চলতে হয়। এই চলা খুব যে কষ্টের তা হয়ত ঠিক তবুও এই শহরে একটা কলেজ স্ট্রীট ছিলো বলে আমরা বেঁচে গেলাম। এখন শনিবার করে হাঁটতে হাঁটতেই চলে যাই সেখানে, পুরনো বই এর ফুটপাতে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে কিনে আনি সস্তায় ফেলুদা থেকে ব্যোমকেশ।
আমার এই ক্ষুদ্র পাঠক জীবনে আমি যা দেখেছি, সেটা পুরোটাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। এখানে কারোর খুব বেশি উপদেশ বা পথ দেখিয়ে দেওয়া নেই। তাই হয়ত মাধ্যমিকের বই এর ফাঁকে একটানা পড়ে শেষ করেছিলাম 'সেই সময়', মাত্র এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে। আর তসলিমা নাসরিন পড়ে কেঁদে ফেলেছিলাম মাঝ রাত্রে, হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল 'নির্বাচিত কলাম'। সেই অপরিণত মন নিয়ে এসব পড়ার পর কি ঘটেছিলো, ক'রাত ঘুমাইনি আজ সেসব ভাবলেও হাসি পায়। তবুও কারোর দিক নির্দেশ না পাওয়া এই শুরুর যেই পাঠক জীবন তা আমায় নাদান থেকে একেবারেই অকালপক্ব করেনি। বরং সমঝে চলতে শিখিয়েছে আমার শুরুর বয়স গুলোকে।
অবসর থেকে উৎসব তাই আজ যদি কেউ কিছু দিতে চায় তাকে বলি বই দিতে। আর আমি কিছু যদি চাই সেটাও সেই বই। আমার মনে হয় আমাদের বই ছাড়া অন্যকিছুই উপহার হওয়ার ছিলো না তবুও এই তৃতীয় বিশ্বের সময় বাঙালি মন একটু একটু করে যে বদলে গেলো, তা অনেকটা বই-হীন হওয়ার কারণেই। তাই আজ নিজের ক্ষুদ্র পাঠক জীবনের না-কথা গুলো লিখতে গিয়ে এটুকুই চাই, যেন এই জাতি, এই শহর, এই বিশ্ব আমার মতোই না-পাঠক থেকে হ্যাঁ-পাঠক হয়ে ওঠে আর প্রত্যেকের ছোটো বড়ো শহরের যেই ধুলো পড়া আধ বন্ধ লাইব্রেরি, সব যেন ডেকে নেয় হয়ে ওঠা পাঠকদের..ঠিক অনেকটা যেন হ্যামিলানের প্রাচীন বাঁশিওয়ালার মতো।