পড়ুয়া

Share this post

অসুখে কিংবা সুখে বইয়ের মতো বন্ধু আর কে আছে

www.porua.net

Discover more from পড়ুয়া

বই নিয়ে পাঠকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো প্রকাশের তেমন সুযোগ থাকে না। পাঠকের বলা না হয়ে ওঠা সেইসব কথাগুলো প্রকাশের ভাবনা থেকে আমরা শুরু করছি পাঠকের জন্য "পড়ুয়া"।
Over 2,000 subscribers
Continue reading
Sign in

অসুখে কিংবা সুখে বইয়ের মতো বন্ধু আর কে আছে

মোনালিসা ঘোষ

Apr 20, 2023
Share this post

অসুখে কিংবা সুখে বইয়ের মতো বন্ধু আর কে আছে

www.porua.net
Share
gold and brown dragon statue under cloudy sky during daytime
Photo by Anshuman Abhishek on Unsplash

জীবনটা শুরু হয়েছিল অসুখ বিসুখ জাতীয় বোকা বোকা ব্যাপার স্যাপার দিয়ে এবং কাল এসে বলে দিয়ে যায়নি কখনই যে কতকাল ধরে এমনটা চলবে। তাই অক্ষর পরিচয় না থাকার কারণে আর শুয়ে থাকতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে শুরু হলো, গল্প শোনা। যে গল্পটা শোনা হতো, সেটা চালান হয়ে যেত পেটের ভেতরে।

মুখ দিয়ে কথা বেরোতো না ঠিক মতো, সে শুনল কালিদাসের সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে হওয়ার গল্প।

পড়ুয়া is a reader-supported publication. To receive new posts and support my work, consider becoming a free or paid subscriber.

রাজকুমারী পন্ডিত এবং দাম্ভিক ছিল। সব পন্ডিত তার কাছে হেরে পর্যুদস্ত। তারা একজন ভয়ানক বোকার সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে দেওয়ার ফন্দী আঁটছে। এমনি এক অলক্ষুণে সময় বোকা কালিদাস গাছে উঠে ডালের সামনে বসে ডগার দিকটা কাটছিল। ডাল কাটল, ডালের সঙ্গে কালিদাসও পড়ল। পন্ডিতরা ঠাওরালো , ইনিই সঠিক ব্যক্তি রাজকুমারীর জন্য। কালিদাসকে বলা হলো, রাজকুমারীকে বিয়ে করতে হলে মুখ খুলবে না, ঈশারায় উত্তর দেবে। যেমন কথা তেমন কাজ। রাজকুমারী একটা আঙুল দেখাল। কালিদাস ভাবল, একটা চোখ গেলে দেবে বোধহয়। সে দুটো আঙুল দেখিয়ে বোঝাতে চাইল, দুচোখ গেলে দেব।

গল্পটা এখানেই থাক। গল্পের পর গল্প জুড়ে অন্য গল্প হয়। কে যেন আমার জন্য ক্যাডবেরি আনল। জীবনের প্রথম ক্যাডবেরি। কাকীমা খানিকটা খাইয়ে বলল, আবার পরে খাবে। বলে তাকের ওপর তুলে রাখল। বিষয়টা কোনো বাচ্চারই পছন্দ হবার নয়। ঘরে একা। কাকীমা বেরিয়ে গেছে। খাট থেকে নেমে, হামাগুড়ি দিয়ে চেয়ারে উঠে ক্যাডবেরিতে হাত দিতেই কাকীমার প্রবেশ। দুটো আঙুল দেখালাম - চোখ গেলে দেব। চৌকাঠ থেকে কাকীমার প্রস্থান। যে কিনা সীতাকে বলে হীতা আর হীতা নাছকাবি ( নাকছাবি হার্গিস নয় কিন্তু ) খুলে ফেলে দেয়, সে লুকিয়ে ক্যাডবেরি খেতে গিয়ে ধরা পরে বলে কিনা, চোখ গেলে দেব!

দৌড়ে কাকীমা চৌকাঠ থেকেই ঘুরে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, বাড়ির লোকেদের জানান দিতে যে, কি মহৎ বাক্য বলে ফেলেছি , যেটা কিনা ভাবা যায় না!

যায় না হয়ত! জোর কদমে গল্প শোনা পর্ব চলতে থাকল। গ্রিক মিথের অরফিউস এতকষ্টে ইউরিদাইসকে যদি পেল , পৃথিবীতে পৌঁছোনোর আগে সে কেন পেছন ফিরল! খুঁতখুঁত করত আমার মন। নার্সিসাসের সৌন্দর্যের ঘমন্ড যে এক ধরণের অসুখ, সেটা মাথায় ঢোকার বয়স তখনও হয়নি, তাই, ইকোর জন্য কষ্ট পেয়েছিলাম খুব। মনের ভেতর জলের স্রোতের মতো ঢুকতে লাগল হিন্দু মাইথোলজি। ধ্রুব , প্রহ্লাদ , ইত্যাদি পার হয়ে দাঁড়ালাম, দক্ষযজ্ঞে। শিব সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব করে বেড়াচ্ছেন আর সুদর্শন চক্র দিয়ে বিষ্ণু কেটে ফেলছেন সতীর দেহ। দেহের টুকরো যেখানেই পড়ছে, সেখানেই গড়ে উঠছে সতীপীঠ।

এখানে এসে ভারী ধন্দে পরে গেলাম আমি। কলকাতায় কালীঘাটে নাকি পড়েছে কড়ে আঙুল! বাক্স খুলে সেটা পরিষ্কার করার সময় নাকি চোখ বেঁধে পরিষ্কার করতে হয়, নয়তো নাকি অন্ধ হবার সম্ভাবনা। ধন্দে পড়ে গেলাম আমি, কারণ ওটা তো আমার দেখার খুব ইচ্ছে!

এমনি সময় বই পড়তে শিখেছে, আমার এক বন্ধু। সে পড়ে শোনালো হিংসুটে দৈত্য। আমি জপ্ত হয়ে গেলাম একেবারে। চিরকালের জন্য। পরে যখন অস্কার ওয়াইল্ডের লেখা সেলফিশ জায়েন্ট পড়ছি, খোদ ইংলিশে , ভীষণ অবাক লেগেছিল ওনার ভাবনার অভিনবত্বে। জায়ন্ট সাত বছর বাড়ি ছিল না, সে গেছিল তার বন্ধু জায়ন্টের সাথে কথা বলতে অন্য দেশে। যেটা অবাক করার মত ভাবনা এবং সায়েন্টিফিক, সেটা হলো, জায়ন্টরা নাকি খুব শ্লো মোশনে কথা বলে যেহেতু ওদের শরীরটা খুব বিশাল। তাই সামান্য কথা বলতেই ওদের সাত বছর লেগেছিল। যেমন পৃথিবী গ্রহ ৩৬৫ দিনে সূর্যকে পাক খায়, অথচ তার থেকে অনেক বেশি সময় লাগে , পৃথিবীর থেকে যেসব গ্রহ সাইজে বড় তাদের।

যখন সব জায়গা থেকে শীত চলে গেল, কেবল জায়েন্টের বাড়ির ওপর থেকে শীত গেল না, তখন অস্কার ওয়াইল্ডের সেই লিরিকাল বর্ণনা ভোলার নয়। উত্তুরে হাওয়া তার প্রকোপ বাড়িয়ে দিলো আর সে তার দোসর শিলাবৃষ্টিকে ডেকে আনল।

জায়ন্টকে প্রথম চুমু খেয়েছিল যীশু, ছোট্ট ছেলের বেশ ধরে। আর জায়ন্টের গোটা পার্সোনালিটিটাই বদলে গেল।

অনেকদিন অপেক্ষার পর যখন সে বুড়ো হয়ে গেছে, আবার দেখতে পেল সেই ছেলেটাকে। সে তার হাত দেখালো, পা দেখালো। তাকে মারা হয়েছে। জায়ন্ট তার তরোয়াল বার করল, যারা শিশুটিকে কষ্ট দিয়েছে , তাদের মারবে বলে। ছেলেটি বলল, তার আর দরকার নেই, আমি তোমাকে নিতে এসেছি, আমার সঙ্গে চলো। পরের দিন বাচ্চারা খেলতে এসে জায়ন্টকে মৃত পড়ে থাকতে দেখল বাগানে। একটা হাউহাউ কান্না আমাকে পেয়ে বসত। তীব্র কান্না। কেন যীশু এলোনা আমাকে নিতে! এমন একটা অনুভব। আমি যীশুর সঙ্গে যেতে চাই, যীশুর সঙ্গে থাকতে চাই। কোনোদিন চোখ দিয়ে জল পড়েনি, এত তীব্র ছিল সেই কান্না। পরে একটা গান শুনেছিলাম, মন্ কি আঁখসে আঁশু নিকলে তন্ কি আঁখ রোয়ে না! আমি আজও ওরকম খটখটে শুকনো চোখ নিয়ে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছি।

অস্কার ওয়াইল্ডের “দ্য পিকচার অব দ্য ডোরিয়ান গ্রে“ আমাকে তার বিন্যাসের জটিলতায় মুগ্ধ করেছিল, কিন্তু সারাজীবনের জন্য সেলফিশ জায়ন্ট যেমন ভাবে বুকের মধ্যে রয়ে গেল তেমনটা থাকেনি।

রুশদেশের উপকথা, আমাকে ওইরকম একটা চিরকালীন ঘোরের মধ্যে রেখে দিয়েছে আজও।

কিন্তু আরব্য রজনী খুব ভালো লাগলেও তেমনটা ঘটে ওঠেনি। রুশ উপকথার হিরো সবসময়ই ইভান। সে যে কি না করতে পারে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। সে সিভকা বুর্কা নামের ঘোড়ার পিঠে চড়ে এক লাফে তিনতলায় বসে থাকা রাজকুমারীর গালে চুমু খেয়ে ফেলতে পারে। রাজকুমারী ভাসিলিসাকে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য করতে পারে, ইত্যাদি। ইভান বিষয়ে পড়ে আর ভেবে আমার মাথাটা মোটামুটি পুরোটাই খারাপ হয়ে যায়।

এদিকে শালগমের ভাগ না পাওয়ার জন্য চাষীকে শায়েস্তা করবে বলে, চাষীর কুঁড়েঘরের আশে পাশে ঘুরত, কেঠো পা ভালুক। এক তো চাষী তাকে ঠকিয়েছিল, তার ওপর তার পা টাও ভেঙে দিয়েছিল। রাশিয়ার সেই জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট গ্রামে কনকনে শীতের রাতে চাষীর কুঁড়ের আশে পাশে বরফের ওপর ঘুরে বেড়াত কেঠো পা ভালুক আর ছড়া কাটত। এমন একটা মায়াবী ভয়ঙ্কর রাত আমাকে একটা অদ্ভুত শীতের ভেতর টেনে নিত। মোরগের পায়ের ওপর বসানো ডাইনি বাবা ইয়াগার ঘর ঘুরতে থাকত গোল গোল। জঙ্গলের গভীরে। এমন অনেক কিছু। আমি বোধহয় এখনও ওই জগতেই থাকি কারণ ওখান থেকে বেরোনোর কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।

অসুখ-বিসুখেরও শেষ ছিল না, তাই বই পড়ারও বিরাম ছিল না। আমি বছরের পর বছর নাম করা রোগ বাঁধিয়ে রুটিন মাফিক ভুগে নিতাম একটা কাজ সারার মত করে। আর রোগ ব্যাপারটা আমার হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। আমার বন্ধুরা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেল যে বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে বিকেলবেলা আমি তাদের খেলা দেখছি, আর তারা খেলা করে যাচ্ছে।

সময়- সাপেক্ষ অসুখ বিসুখ হচ্ছে বলে আমি একটু মোটা বই-এর দিকে হাত বাড়ালাম। দশ বছর বয়সেই শরৎচন্দ্র , বঙ্কিম চন্দ্র ধরে ফেললাম। ওই বয়সেই রাধারানীকে ন্যাকা মনে হয়েছিল আর গল্পটাকে মনে হয়েছিল সাজানো। বরং তখনকার অবিভক্ত বাংলাদেশে কপালকুণ্ডলার ক্রাইসিস অনেক জীবন্ত লেগেছিল।

শরৎচন্দ্র অনেক পড়লাম। সবই বেশ ভালো লাগল। ভালো লাগল না, ছেলেদের পেলেই সাজিয়ে গুছিয়ে খাওয়ানোর ব্যাপারটা। এটা খাও, ওটা খাও, তারপর আমার মাথা খাও এসব কি ধরণের বায়নাক্কা, আমার ঠিক পোষায়নি। যে গল্পটা পাকাপাকি ভাবে মনের মধ্যে গেঁথে গেল, তা হলো মন্দির। আর শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব, যেখানে ইন্দ্রনাথ আর অন্নদাদিদি ছিল।

ছিদাম বহুরূপীকে পেটানোর সময় কে ভুলবে সেই ডায়লগ, “খোট্টা শালার ব্যাটারা আমাকে কিলায়কে যেন কাঁঠাল পাকায় দিয়া!”

মন্দিরে ছিল অপর্ণা। মন্দির, পূজো, রীতিনীতি সে এমন আপন করেছিল, বিগ্রহকে তত আপন করেছিল কিনা, তার আভাস গল্পের কোথাও পাইনি। মানুষের প্রতি পাথরের মতো অপর্ণাকে, তার স্বামী অমরনাথ বলেছিল, এসো আমরা ঝগড়া করি। অপর্ণা ঝগড়া পছন্দ করত না। অমরনাথ তার জন্য উপহার আনে। সে ভালভাবে গ্রহণ করতে পারেনা। মাত্র কিছুদিনের জ্বরে অমরনাথ মারা যায়। অপর্ণা ফিরে আসে বাপের বাড়ি, সেখানে তার প্রিয় মন্দিরে। মন্দিরে পূজো করত শক্তিনাথ। ক্রমে শক্তিনাথ ভালবাসতে শুরু করে অপর্ণাকে। একদিন অতি কুণ্ঠিত ভাবে সে একটি উপহার আনে অপর্ণার জন্য। ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। উপহার প্রত্যাখ্যাত হয়। কি এক অসুখে মারা যায় শক্তিনাথ। পরপর দুটো ঘটনা অপর্ণার মনের ভিত নড়িয়ে দেয়। সে অনুভব করে তার সংবেদনহীনতা। এটা কেন যে আমার মনে দাগ কাটে তা বুঝিনি। তবে গল্পটা আমাকে ভাবায়।

নিয়মমাফিক ভুগতে ভুগতে উঁচু ক্লাসে উঠতে লাগলাম। হাতে পড়ল হাঁসুলিবাঁকের উপকথা। তারাশঙ্কর হাতে আসার আগে সুন্দরবাবুর একনাগাড়ে চা, টোস্ট আর ডিমের অমলেট খাওয়া পেরিয়ে, স্বপনকুমার সাঙ্গ করে, নিহাররঞ্জনে হাত বাড়িয়ে, ফেলুদা সাবড়ে, শরদিন্দুর তুঙ্গভদ্রার তীরে এবং আরও অনেক কিছু শেষ করে সম্পূর্ণ পরিপাক করে, তারাশঙ্করে এলাম। বগলে রবীন্দ্রনাথ আর মানিক বন্দোপাধ্যায় যুগলে।

তখন আর অসুখের ছুতোর দরকার হয়না। বই তখন অসুখের মত অভ্যেস হয়ে গেছে।

তারাশঙ্কর আর রবীন্দ্রনাথ একযোগে আমাকে গ্রাস করে নিল। আমি নাগিনীকন্যাতে হারালাম, ডাইনিতে হতবাক হলাম। আর রাইকমলে বিভ্রান্ত হলাম। কিন্তু হাঁসুলিবাঁকের উপকথাতে থমকে এবং চমকে গেলাম, কারণ তারাশঙ্কর একটা চলমান সময়ের কথা বলতেন। একটা কাল যেটা সমানেই চলছে, থামার নাম নেই। হাঁসুলিবাঁকের উপকথা যেন সেই চলমান সময়ের গল্প বলে গেল। একটা সিস্টেম যেটার কার্যকারীতা ফুলেস্ট লেভেলে ছিল, সেখান থেকে শুরু হলো তার পতন, আর সেই পতনের গর্ভ থেকে উঠে এলো একটা নতুন সিস্টেম যা নতুন করে গড়ে তুলবে অনেক কিছু। এখানে ভালো অথবা মন্দের প্রশ্ন ছিল না, যেটা ছিল সেটা হলো যুগোপযোগীতা। পুরনোকে যেতেই হয়। যাওয়াটা অনিবার্য। আর নতুনকেও আসতেই হয়। তার আসাটাও অমোঘ। আমি হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমি কালের পেছনে দৌড়চ্ছি কালকে ধরতে, কালকে বুঝতে। আর ক্রমে আমিও কাল-কবলিত হয়ে পড়ছি আমারই অজান্তে। আমি চিরকালের জন্য কালের বন্ধু হতে চাইলাম। কিন্তু ক্রমেই বুঝতে পারলাম, কালের বন্ধু হতে গেলে আমায় নিরন্তর কালের সঙ্গে হাঁটতে হবে সচেতন ভাবে। তাই আমি হাঁটতে লাগলাম।

কালের নিয়মে এমন সময় জন্ডিস হয়ে গেল। তাই হাতে কিছুটা সময় পাওয়া গেল। টলস্টয়ের আনা ক্যারেনিনা হাতে এলো। তখন অষ্টম শ্রেণি, তখন আমি তেরো। একটা এক্সট্রা ম্যারাইটাল হলো। সে যা হলো , তা হলো। কিন্তু আনা বারবার একটা বুড়োকে রেল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখত। শেষে আনা ওই রেল লাইনেই সুইসাইড করল। আমি বুড়োটাকে বুঝতে পারিনি। ও কি ছিল? যে সময় চলে গেছে, সেই চলে যাওয়া সময়ের মূল্যবোধের প্রতীক ? ও কি আনার বিবেক? আনার অপরাধবোধ? কি জানি!

পদ্মা নদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা এরা সব জীবনে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় আর শাস্তি আমাকে কোনঠাসা করে ছাড়ল। পরে রবীন্দ্রনাথের অনেক নাটক আমায় মুক্তির হাওয়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। গুরু, ফাল্গুনীর অন্ধ বাউল, রক্তকরবী। এমনি সময় একটা বই পাওয়া গেল হাতে। রাত ভ’রে বৃষ্টি। মনের ভেতরের ধাক্কা হিসেবে ওটা ছিল একটা বিচ্ছিরি ধাক্কা।

পড়ার পর আমি বইটা আমার মাস্টার মশাইকে দিলাম পড়তে। অনেক যখন বয়স হয়ে গেছে , তখন এই মাস্টারমশাইকে নিয়ে গল্প লিখি, মেটামরফোসিস। গল্পটা হঠাৎ ২০০৬ সালে বেরোনো সুনীল গাঙ্গুলীর কৃত্তিবাসের গল্প সংখ্যায় বেরোয়। কৃত্তিবাসের গল্প সংখ্যা ছাপা হয়না সাধারণত। ১৯৫৭ সালে বোধহয় একটা ছাপা হয়েছিল। তাতে লিখেছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী ইত্যাদি। তারপর ২০০৬ এর পর আর আজ অবধি বেরিয়েছে কিনা জানা নেই। কৃত্তিবাস কবিতা পত্রিকা হিসেবে এখনও বহাল আছে অবশ্য।

মাস্টারমশাই-এর প্রসঙ্গে আসি। উনি আর আমি যত না অঙ্ক করতাম, তার চেয়ে বেশি বই দেওয়া নেওয়া করতাম, যদিও উনি আমার বাবার বয়সী ছিলেন। “দেশ” পত্রিকায় তখন বুদ্ধদেব গুহর “মাধুকরী” চলছে। মাস্টারমশাই আমাকে জানালেন, “রাত ভ’রে বৃষ্টি” এমন একটা উপন্যাস, যাতে প্রেমের মৃত্যু দেখানো হয়েছে। তাই নিয়ে তর্কাতর্কি, বেজায় ঝঞ্ঝাট। আমি তখন তেরো থেকে পনেরো। সামনে বোর্ড এক্সাম। এহেন সময়ে প্রেমেরও মৃত্যু হয়, এটা যদি মানতে হয়, তাহলে তো আমি পাগল হয়ে যাব!

সেই সময় বাঁচিয়ে দিলো সমারসেট মম্। বাবা বেঁচে থাক তার উপন্যাস। আমি রেজার্স এজে ঢুকে গেলাম। তারপর সেখানেই ঘুরপাক খেতে লাগলাম। তারপর সানস্ এন্ড লাভারস্, এইচ , জি ওয়েলস্। মা আর ছেলের প্রেম। ঈডিপাস কমপ্লেক্স। তাই ছেলের কোনো প্রেম টেকেনা। পরবর্তীকালে আমি সাইকোলজিস্ট প্রফেশনে এসে এই ধরণের প্রচুর কেস পেয়েছি এবং সিদ্ধান্তে এসেছি যে, মা আর ছেলের এই বিদ্ঘুটে নাজায়েজ সম্পর্কটা ঠিক কখন কি কারণে ঘটে যায়, তা তারা নিজেরাও বুঝতে পারেনা। অসুবিধেজনক ব্যাপার।

সুনীল, শীর্ষেন্দু , নবনীতার সঙ্গে আমার জীবনে যিনি প্রবেশ করেছিলেন, তিনি ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। মাথাখানা আমার পুরোদমে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিলেন তিনি। “দেশ” শারদীয়া পত্রিকায় তাঁর প্রথম উপন্যাস পড়ি। নাম মনে নেই। যেটা মনে আছে সেটা হলো পাখি স্বভাব মেয়ে। এই বাক্যটা। একটি ভদ্রলোক তার ঘরে একা বসে থাকেন। একটি মেয়ে তাদের বাড়িতে থাকে। মেয়েটি দরজার কাছ থেকে মাঝে মাঝে দেখে।

কিন্তু তাকালেই সে সরে যায়। যেমন পাখিরা বারান্দায় বা ছাদে টুকটুক করে কাছে আসে লাফিয়ে বা হেঁটে। পাখির দিকে এটেনশন দাও, ওমনি সে উড়ে পালিয়ে যাবে। ওই মেয়েটি তেমন। কখন যেন বড় হয়ে গেলাম। দুম-দারাক্কা। সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ, হিমু আর মিশির আলি থাকত। হুমায়ূন আহমেদের ওপর মাঝে মাঝে দারুণ রাগ হতো। সারাক্ষণ উনি জ্বর হলে জল চিকিৎসা করান। মিশির আলিকে সাইকোলজিস্ট বানিয়েছেন, যিনি খালি রোগে পড়েন, কঠিন রোগে। তার চিকিৎসার ভার কেউ না কেউ নেয় , উনি সেরে ওঠেন। আমি সাইকেলজিস্ট এবং রোগে পড়ি এবং সেরে উঠি । কিন্তু দেখলাম মিশির আলিকে সাইকোলজিস্টের চেয়ে অনেক বেশি গোয়েন্দা বলে মনে হয়।

দেখুন সহৃদয় পাঠক, যথেষ্ট রাগ তো হবারই কথা। উনি ক্লায়েন্টের বাড়িতে থাকতে যাবেন। তারপর তাকে বুঝিয়ে বলবেন আর বোঝালেই নাকি একজন সিৎজোফ্রেনিক রুগী বিনা চিকিৎসায় বিনা ওষুধে সেরে যাবে। একি মামদোবাজী নাকি! উফ্, আমার উচিত ছিল , যাহোক করে ওনার একটা ইন্টারভিউ নেওয়া আর এই সব প্রশ্ন গুলো করা। মাঝে মাঝে মিশির আলি ক্লায়েন্টের আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি যাবেন আর দু ঘন্টা বসিয়ে রাখার পর তারা আসবেন, মিশির আলি কিছু প্রশ্ন করবেন এবং চলে যাবেন। চলে যাবার সময় কলা , পাউরুটি আর মাখন একটা প্যাকেটে ফেলে রেখে আসবেন। লেখকের ওপর রাগে আমার মেঝেতে পা ঠুকতে ইচ্ছে করত! কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার উপন্যাস পড়তে গিয়ে ওনার প্রতিভায় আমি তাজ্জব হয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কিন্তু আবার অন্য উপন্যাস পড়ে মনে হতো জোরকদমে রাগারাগি করি। দুবার চিঠি লিখেছিলাম। যথাস্থানে পৌঁছোয়নি। আমি একটা গাধা।

কালেদিনে অনেক কাল কেটে গেল। আমি পড়লাম মার্কেজ। হান্ড্রেড ইয়ারস্ অব সলিটিউট। একটা মাকোন্দো নামের অদ্ভুত গজিয়ে ওঠা শহরের এক আজব বুয়েন্দিয়া পরিবার আমাকে তাদের জীবন-সংগ্রামের রক্ত - মাংসের গন্ধে ভরা দিনগুলোতে এমন ভাবে টেনে নিল যেন তারা একটা চুম্বক আর আমি বোধহয় লোহা। ডিমেন্সিয়া অর্থাৎ ক্রমে ক্রমে একটা গোটা শহরের সবাই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে আর ডিমেন্সিয়া একটা মহামারীতে পরিণত হচ্ছে, তখন মাকোন্দোর মানুষদের মনে রাখার প্রচেষ্টা একটা সংগ্রামের রূপ নিয়েছিল। অবিশাস্য। রেমেদিওস একটা গোটা চাদর শুদ্ধু আকাশে উড়ে হারিয়ে গেল, কারণ তার বেঁচে থাকার ব্যাপারটা বোকার মত লাগত। উরসুলা যখন অন্ধ হয়ে যাবে বুঝতে পারছে, সে প্র্যাকটিস শুরু করে দিলো, পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেলেও সে কীভাবে স্বচ্ছন্দ্যে কাজ করে যাবে। নাহ, আমি বুয়েন্দিয়া পরিবারকে মন থেকে মানিনি, কিন্তু তাদের অস্বীকারও করতে পারিনি কোনোদিন। শুধু উপন্যাসটা পড়ে মনে হয়েছিল, এমনও লেখা যায়!

দ্য ক্রনিকল অব দ্য ডেথ ফোরটোল্ড উপন্যাসে, মার্কেজের একটা গল্পকে একটা আজব পদ্ধতিতে চালিয়ে নিয়ে যেতে যেতে প্রায় একটা গোটা শহরের মানুষদের সাইকোলজিক্যাল ডাইলেমা এবং আটকে থাকা মনকে তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে সেই সমাজটা যে আসলে এত পচে গেছে যে গন্ধ বেরোচ্ছে, সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে এসেছিল। বাপরে বাপ ! কি লেখনি! সারা শহর এবং মানুষজন এবং প্রকৃতি সবাই যেন বাধা দিচ্ছে সান্তিয়াগো নাসার যেন খুন না হয়। সবাই জানে যে বিকারিও ভাই-এরা তাকে খুন করবে, আর সবাই চাইছে যে সে বেঁচে যাক, এমনকি একটা সময় আমার মনে হতে লাগল যে , বিকারিও ভাইরাও চাইছে যে সান্তিয়াগো বেঁচে যাক, তবুও খুন হলো, এবং খুন হবার সময় সান্তিয়াগো বিশ্বাস করল যে সে খুন হচ্ছে।

আমাকে এমন তাজ্জব করেছে , আরও অনেক উপন্যাস। নাগিব মেহফুজের “আখেনাতেন”, ওরহান পামুকের “স্নো”। অবিশাস্য প্লট আর তেমনি লেখনি। কিন্তু ততদিনে আমার ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, হুমায়ূন আহমেদের বাক্য গঠন, মার্কেজের স্টাইল আর তারাশঙ্করের কালের অমোঘ যাত্রা। মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি হয় আরেক শৈলী। সুনীল গাঙ্গুলীর প্ররোচনায় আমি লিখতে শুরু করি বিশাল ক্যানভাসে, “স্থান কাল পাত্র”, যেখানে মহাদেশ গুলো সাতটা মহাসমুদ্রের ওপর শ্যাওলার মতো ভাসছিল আর বাক্স-প্যাটরা নিয়ে মানুষেরা এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ পাড়ি দিচ্ছিল কেবলই, আরও আরও ভালভাবে বাঁচার জন্য আর স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং বাড়ানোর জন্য। স্থান এবং কাল ছিল তার সাক্ষী। আমি লিখতে থাকি।

“আমি দোহা বলছি। সেই এক ভয়ঙ্কর দাবদাহ এসে পড়ল। কারণ পৃথিবী ঘুরছেই। পৃথিবী বিনা চাকায় বিনা যন্ত্রে তাওয়াফ করে চলেছে, কোনো অমোঘ নিয়মের বশে। সেই নিয়ম অনিবার্য। তাকে দেখিনি কখনও চোখে অথবা ছুঁয়ে। শুধু অনুভব করেছি সে আছে। যেমন আমি আছি। সূর্যের যখন উত্তরায়ণ হয়েছে, আমার ওপরের ধূসর বালি হয়ে উঠেছে আরও ধূসর আরো উত্তপ্ত, যে বালির কণা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাবার পরেও আরও মিহি গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আর বালির মধ্যে থেকে সাদা ধোঁয়ার মত উঠেছে ভাপ, তখন বুঝেছি, সে আছে। ক্রমে সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হয়েছে আর মসজিদে মসজিদে তলবিয়া পাঠ শুরু হবার আগেই সুবেহ-সাদিকের আলো আঁধারিতে মরুভূমির বুকে জমে উঠেছে গভীর কুয়াশা। সে কুয়াশায় দিশা পাওয়া যায় না , হাজার উঠের কাফেলা বেবাক গায়েব হয়ে যায়। মরুদ্যান হারিয়ে ফেলে বেদুইন । দুহাত দূরের মানুষকে ঠাহর করা যায় না। আমি তখন বুঝেছি সে আছে। আদিহীণ , অন্তহীন এক মহাসময় আমাকে হাত ধরে চিনিয়েছে সে আছে। আমার মনে আছে সাতাশে রজবের কথা। রাত তখন গভীর। আরব মরু স্তব্ধ । বোরাক নিয়ে পৌঁছোলেন জিব্রাইল। কাবা থেকে শুরু হলো রসুলের সেই অদ্ভত নভোভ্রমণ। সাত আকাশের শেষে রসুল পৌঁছোলেন, সিজরাতুল মন্তাহায়। জিব্রাইল দাঁড়িয়ে পড়ল কিন্তু রসুল এগিয়ে চললেন আরো ঊর্ধ্বলোকে। এসে পৌঁছোলেন অপূর্ব নুরের তাজাল্লিতে ভরা বায়তুল মামুরে। তিনি সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মহাকালও চিৎকার করে উঠল আনন্দে, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ।”

লেখা শেষ হলো, আরও কত লেখা শুরু হলো। আরও কত লেখা পড়া হলো। এই লেখায় বোরহেজের কথা বলা বাকি রয়ে গেল। সময় বলল, অন্য সময় হবে।

আমি পেছন ঘুরলাম। এক অন্য সময়ের মুখোমুখি হলোাম। কৃষ্ণ মারা গেছেন। দ্বারকা জলমগ্ন। ধ্বংস। দ্বারকার নারী, শিশু, বৃদ্ধ হস্তিনাপুরের উপকন্ঠে বসবাস করছে। আহির দস্যুরা আক্রমণ করল। নারী আর গোবাদি পশু হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল তারা। গান্ডীব তুলে নিলেন অর্জুন। রথ ছুটছে। তীর বর্ষণ চলছে। একদা মহাবীর অর্জুনের চোখের সামনে দিয়ে দস্যুরা সব হরণ করে নিয়ে গেল।

* এই ঘটনা মহাভারতে ২৪ টা পংক্তি জুড়ে অর্জুন বর্ণনা করলেন মহাভারতকার ব্যাসদেবকে। ২৪টা পংক্তি চুপ করে শোনার পর ব্যাসদেব উত্তর দিলেন , কেবল একটা শব্দে, “কাল” ।

পড়ুয়া is a reader-supported publication. To receive new posts and support my work, consider becoming a free or paid subscriber.

Share this post

অসুখে কিংবা সুখে বইয়ের মতো বন্ধু আর কে আছে

www.porua.net
Share
Previous
Next
Comments
Top
New
Community

No posts

Ready for more?

© 2023 Riton Khan
Privacy ∙ Terms ∙ Collection notice
Start WritingGet the app
Substack is the home for great writing