

Discover more from পড়ুয়া
বইয়ের সাথে আমার সখ্য সেই অ আ ক খ এর সময় থেকে। কোনো কোনো বই পড়ে অসহ্য কষ্টে অস্থির হয়েছি আবার কোনো কোনো বই আমাকে আনন্দ রথে চড়িয়েছে। এমন অনেক বই পড়ে আমার নিশ্বাসবন্ধ হয়ে গেছে। মনে হয়েছে আমি এখনই মারা যাচ্ছি। না কষ্টে নয়। অদ্ভুত ভালো লাগায়। বই আমাকে সব সময় অন্য এক ভুবনে নিয়ে যায়। যেখানে আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়াতে পারি, একঘর বই দেখলে নিজেকে পাগল পাগল লাগে।
তখন আমি এসএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। দোরগোড়ায় পরীক্ষা। দিনের বেশির ভাগ সময় বই নিয়ে কাটে। এমন যখন আমার পাগলপারা অবস্থা তখন একদিন বোধহয় রাত্রি আটটা মত হবে, আমার বড় মানে তিন বছরের বড় যে ভাই সে দেখলাম একটা বই এনে টেবিলের উপর রাখলো। হলো না রত্না। নতুন বই। পড়তে হবে কিন্তু এখন গল্পের বই হাতে নিলে খবর আছে। এদিকে এই বই না পড়ে থাকি কি করে! রত্না আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর নাম। ভাবলাম রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে পড়বো। ভাবনা মতো কাজ। রাতে গণিত বইয়ের নিচে রেখে পড়া শুরু করলাম। অবশ্যই সবাই ঘুমিয়ে গেলে। রাত বাড়তে লাগলো, আমি হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ছি। শুনশান নীরব রাত। লাইট জ্বালিনি পাশের ঘরে আলো যাবে। রাত বোধহয় তিনটা, বই শেষ হলো কিন্তু আমার শেষরক্ষা হলো না। একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলাম। তারপর? থাকনা। নাই বা বলি।
সরদার ফজলুল করিমের সেই সে কাল, কিছু স্মৃতি কিছু কথা আমার ভালো লাগা এমন এক বই যা পড়ে আমি উদ্বেলিত হয়েছিলাম। দুপুর থেকে পড়া শুরু করেছিলাম শেষ হলো যখন তখন সন্ধ্যা। পড়া শেষ করে মনে হলো আমি কিছুই দেখিনি জীবনের। আমার সামনে কোনো স্বপ্ন নেই। তাঁরা ইংরেজদের হাত থেকে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য কত কিছু করেছেন।খুব আপসোস হলো কেন সে সময় জন্ম নেই নি। আর অদ্ভুত ভালো লাগায় আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমি কি করি, কাকে বলি। সে এক ভয়াবহ অবস্থা।
বুদ্ধদেব বসুর ছোটগল্প সংকলন ‘ভাসো, আমার ভেলা’, বইয়ের গল্পগুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা,পল্টন এইসব এলাকা গুলির অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা। পল্টনের একটা বট গাছের কথা এখানে আছে যা কেটে ফেলার কথা চলছে। আমি মনে মনে অনেক খুঁজেছি গাছটাকে। পাইনি। এখানে একটা গল্প আছে সবিতা দেবি। তাঁর কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আসতেন, একদিন ঝুম বৃষ্টিতে উনি ছাতা নিয়ে এসেছেন। ভেজা ছাতা রেখেছেন ফুটরেস্টে,পানি গড়িয়ে দাগ হয়েছে।উনি আসতেন সবিতা দেবিকে নিজের লেখা কবিতাশোনাতে। গল্পটা যখন পড়ি তখনই মনে দাগ কেটেছিল। বেশ অনেক পরে আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটিতে এই বাড়ি,গড়িয়ে আসা পানির দাগের বিবরণ। সেই শিক্ষকের কথা, আমি মুগ্ধতায় আপ্লুত হলাম।
সুনীল গাঙ্গুলীর ‘রানু ও ভানু’ পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। শেষটা তো মারাত্মক সুন্দর। মনের মাঝে ভালো লাগার এক অনুরণন। মনের আকুলি বিকুলি, কি লিখতেন ভানু চিঠিতে? এই অসম বয়সী দুই বন্ধুর ভালো লাগা, বন্ধুতা আমাকে অন্য এক জগতে নিয়ে গেল। একদিন বিকেলবেলা কোনো কাজ ছিল না। পুরাতন পূজা সংখ্যা দেশ পড়ছিলাম। ও মা এর মাঝে রানুর ছবি,ভানুর চিঠি। কি সুন্দর দেখতে লেডি রানু মুখার্জি ! বইটা যখন পড়ি তখন ভাবিনি রানু সত্যি, ভেবেছিলাম কাল্পনিক। আমি ভালো লাগায় আপ্লুত, অস্থির। রক্ত করবীর নন্দিনী। থরথর কাপঁছি আবেগে।কাকে বলি আমার এ আবেগের কথা। না বলেও স্থির হতে পারছিনা। উত্তেজিত আমি বোনকে ফোন করলাম। উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে জানালাম আমার আবিষ্কার। ও আমার উচ্ছ্বাসে এক বালতি জল ঢেলে দিলো। ভাবটা এমন এটা কোনো বিষয় না।
আমি কি করে বলি আমার মনের ভিতর তখন কি ঝোড়ো হাওয়া বইছে। রানু সত্যি ছিল, যাকে ভেবে কবি গুরু নন্দিনী সৃষ্টি করেছেন, রানু যেন আমার কতকালের চেনা। হয়ত সত্যি সেদিন ধুপের ধোঁয়ার মাঝে চিরদিনের জন্য ভানুকে ছেড়ে এসেছে। তখন চোখে চোখে কি কথা হয়েছিল? খুব জানতে ইচ্ছা করে।
কত বই পড়ে আমি কেঁদেছি, ভালো লাগায় বুঁদ হয়েছি, মনে হয়েছে হাঁটছি সেই সময়ের পথে। বই পড়ে কখনো ভালোলাগা, কখনো খুব কষ্ট, কখনো অন্য একজগতের হাতছানি। আমি যেন বইয়ের ভিতর দিয়ে সেই সময়ে চলে যাই।
বই আমার নিত্যদিনের সঙ্গী, আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, প্রিয় সখা; পরাণ সখা।