পড়ুয়া

Share this post

প্রিয় লেখক, প্রিয় বই ও সেই আলো-আঁধারির দিনগুলো

www.porua.net

Discover more from পড়ুয়া

বই নিয়ে পাঠকের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো প্রকাশের তেমন সুযোগ থাকে না। পাঠকের বলা না হয়ে ওঠা সেইসব কথাগুলো প্রকাশের ভাবনা থেকে আমরা শুরু করছি পাঠকের জন্য "পড়ুয়া"।
Over 2,000 subscribers
Continue reading
Sign in

প্রিয় লেখক, প্রিয় বই ও সেই আলো-আঁধারির দিনগুলো

হামিরউদ্দিন মিদ্যা | গ্রীষ্মের টানা ছুটি পড়েছে। দুপুরে শুয়ে আছি, একদিন মিলন আমাদের বাড়ি এসে হাজির। সঙ্গে বগলদাবা করে একখানা বই। বইটা আমার হাতে দিয়ে আবেগ আর ধরে রাখতে পারল না। সদ্য পড়েছে সে।

Apr 27, 2023
Share this post

প্রিয় লেখক, প্রিয় বই ও সেই আলো-আঁধারির দিনগুলো

www.porua.net
Share

তখনও আমাদের গাঁ-গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ঢুকেনি। গ্রীষ্মের গরমে হাবুচুবু খাচ্ছে মানুষগুলো। তালপাতার হাত পাখা, কিংবা বাঁশের নল লাগানো বেতের বোনা ঘড়ঘড়ি পাখায় একমাত্র সম্বল। গ্রামের সন্ধ্যাবেলা। চারপাশে একটু তাড়াতাড়িই আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। উঠোনে ঝাঁট দিয়ে তালাই বিছিয়ে লন্ঠনের আলোয় আমি আর নয়নাদিদি পড়তে বসেছি। ফাঁকে বসলে গায়ে হাওয়া লাগে। নয়নাদিদি ক্লাস ফোরে উঠেছে। নতুন বই পেয়েছে স্কুল থেকে। আর আমি বর্ণপরিচয়ের 'ঐক্য বাক্য' পাঠ শেষ করে সবে 'রূপপাল' প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দাদো লাঠি ঠুক ঠুক করে এসে রোজদিনের মতো মেচেতে বসে ফুক ফুক করে বিড়ি ফুঁকছে, আর আমার বাপ-চাচাদের সঙ্গে চাষবাস, গোরু-ব্যাবসা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। একটু দূরে লন্ঠনের মৃদু আলোয় দাদি কাঠের পিঁড়ের ওপর বসে বসে আন্দাজেই তালাই বুনছে। আমার মন তখন পড়ে আছে নয়নাদির বইয়ের ওপর। নিজের পড়া বন্ধ করে লন্ঠনের ওপ্রান্তে উঁকি মেরে দেখছি নয়নাদিদির নতুন বইয়ের ছবিগুলো। আমার থেকে কত উঁচু ক্লাসে পড়ে নয়নাদি!ইয়া মোটা মোটা বই!আমিও যে কবে বড় হব!নয়নাদির মতো অতগুলো বই হাতে পাব!

ছেলেবেলার সেই সন্ধ্যাগুলোর কথা এখন খুব মনে পড়ে। পড়তে বসে সবসময়ই নয়নাদিদির পড়াগুলো কান খাঁড়া করে শুনতাম। আমি ভ্যাবলার মতো চেয়ে আছি দেখে মাঝেমধ্যেই মায়ের কাছে নালিস জানাত নয়নাদিদি, হা দেখ-অ চাচি। ভাই নিজে না পড়ে তুমাদের কথাবার্তা শুনছে।

মা পাখার বাঁট দিয়ে পিঠে ফটাস করে ঘা মেরে বলত, ফাঁকিবাজি বের করব!কী শুনচিস কান পেতে? মন দিয়ে পড়। না পড়লে অনেক দূরের মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিব। আর আসতেই পারবি না।

মাদ্রাসার নাম শুনলেই খুব ভয় পেয়ে যেতাম। আমাদের পাড়ার বাসিরুল কাকার ছেলে ফরিদকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়েছে ওর বাবা। কত দিন হয়ে গেল!সে আর বাড়ি ফেরেনি। ভয় পেয়ে পড়তে শুরু করলাম, "চরে বসে রাঁধে ঙ, চোখে তার লাগে ধোঁয়া। " উঁনুনশালে বসা সাদাকালো ছবির মধ্যে বুড়ির মুখটি দেখা যাচ্ছে না। মুখ না দেখা গেলেও মানুষটিকে আমি চিনি। বুড়িটি কে? সে আর কেউ নয়, আমার দাদি। রান্নাশালে ওই ভাবেই তো বসে বসে রাঁধে। যখন খড় পুড়িয়ে রান্না করে, তখন ধোঁয়ায় চোখে জল আসে। এক একটা ছবির সঙ্গে, বইয়ের চরিত্রগুলোর সঙ্গে আমার চারপাশের দেখা মানুষগুলির মুখ মনে মনে কল্পনা করে নিতাম। কবিতা গল্প আমাকে ভীষণ টানত। ছোট থেকেই নতুন বই ছুঁয়ে দেখার, পড়ার প্রতি একটা আগ্রহ কিভাবে যেন রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সেই নেশাটা এখনো আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াই।

গ্রামের স্কুলে পড়াশোনার পাঠ শেষ করে যখন পাশের গ্রাম হরিশ্চন্দ্রপুরের হাই ইস্কুলে ভর্তি হলাম, তখন আমার জগতটার পরিধি আরও বেড়ে গেল। কত নতুন নতুন বই। কত বন্ধুবান্ধব। কত মাস্টার দিদিমনি।

স্কুলের একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি ছিল। সেখান থেকে একটা করে বই নিয়ে পড়ার সুযোগ ছিল। ঠাকুমার ঝুলি, রূপকথার গল্প, নন্টে-ফন্টে, হাঁদাভোঁদা, বাটুল দ্য গ্রেট, আরও বিভিন্ন কমিক্স, গল্পের বই তুলে নিয়ে যেতাম বাড়িতে, তারপর গোগ্রাসে গিলে ফেলতাম।

আমাদের গ্রামের রায়পাড়ার মিলন একই স্কুলে পড়ত। সে ছিল আমার থেকেও এক ক্লাস উঁচুতে। বই পড়ার সুবাদেই দু'জনের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। অদলবদল করে আমরা অনেক বই পড়েছি।

গ্রীষ্মের টানা ছুটি পড়েছে। দুপুরে শুয়ে আছি, একদিন মিলন আমাদের বাড়ি এসে হাজির। সঙ্গে বগলদাবা করে একখানা বই। বইটা আমার হাতে দিয়ে আবেগ আর ধরে রাখতে পারল না। সদ্য পড়েছে সে। বলল, পড়ে পাগল হয়ে গেছি রে ভাই!এমন বই আর কক্ষনও পড়িনি। গোটা বই জুড়ে একটাই বড় গল্প!সিনেমার মতন। আফ্রিকা মহাদেশ!পাহাড়, জঙ্গল, সিংহ, বুনিপ বুঝতে পারছিস কিছু?

আমি মাথা নাড়ি। বইটাই তো এখনও পড়লাম না। আগে শেষ করি, তবে তো বুঝব!

আজই শুরু কর। কাল এসে আবার খোঁজ নেব, কতটা পড়া হল শুনব।

একটা বই নিয়ে মিলন এমন মাতামাতি যখন করছে, নিশ্চয়ই কিছু তো আছে। তাছাড়া ওর আমার রুচি, পছন্দ অপছন্দের একটা মিল ছিল। যে বই ওর ভালো লাগত, সেই বই আমিও পড়ে তৃপ্তি পেতাম। সেদিনেই পড়তে শুরু করলাম। পাগল হয়ে যাবারই কথা!এমন একটি বই পড়ার জন্যই তো এতদিন অপেক্ষা করেছি!বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল, মা ডাক পাড়ল, অনেক পড়েছিস, এবার চাট্টি মুড়ি খেয়ে নিবি আয়।

বললাম, মুড়ি খাব না।

হ্যাঁ, তা খাবি কেনে!পড়ে দুনিয়াটাকে উদ্ধার করে দিবি।

তখন আমি আফ্রিকার দূর্গম জঙ্গলে আমাদেরই বাঙালি এক যুবক শঙ্কর আর পোর্তুগীজ অভিযাত্রী দিয়েগো আলভারেজের সঙ্গী হয়ে হীরের খনির সন্ধানে। কত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, দূর্গম পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে। খাওয়া-দাওয়া করে আবার বইটা নিয়ে বসি। মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরের এককোনে লাইট জ্বেলে পড়ছি। চারিদিক নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে। বাড়ির অবয়বটা ধীরে ধীরে মুছে গিয়ে কখন যেন একটা তাবুতে পরিণত হয়। কাঁথার ফাঁকে বেরনো আব্বার পাগুলো আলভারেজের পা। বাইরে বুনিপের পদশব্দ!মাঝে মাঝে জঙ্গলের বুক চিরে রাতের নিঃস্তব্ধতাকে খান খান করে ভেঙে দিয়ে ভেসে আসছে হায়েনার অট্টহাসি, গরিলার বুক চাপড়ানোর শব্দ। কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি। কত রাত আমার মনে নেই। বইটা শেষ করে ওখানেই ঘুমে ঢলে পড়েছিলাম।

পরেরদিন মিলন আমাদের বাড়ি আসতেই মা ধমক দিল, তুই আর খোকার মাথাটা খাস না বাপ। কি এক বই দিয়ে গেলি, ছেলেটা আমার খায়ওনি, ঘুমায়ওনি। বলি শুধু গল্পের বই পড়লেই হবেক!স্কুলের বইগুলো পড়তে হবেকনি?

আব্বা বলল, এমন কথা বলো কেনে!ছেলেটার বইপড়ার নেশা, এ তো ভালো জিনিস। তুমার ছেলে তো আর, আর পাঁচজনের মতো ড্যাডাং ড্যাডাং করে ঘুরে বেড়াই না। এখন ছুটির সময় পড়লই বা দু-একটা গল্পের বই।

চাঁদের পাহাড় নিয়ে মিলনের সঙ্গে অনেক আলোচনার পর আমরা দু'জনে সিদ্ধান্ত নিলাম, জীবনে কিছু হতে পারি আর না পারি, একবার আফ্রিকা মহাদেশ যাব।

হাঁড়ির একটা চাল টিপলেই বোঝা যায়, ভাত কেমন হয়েছে। চাঁদের পাহাড় উপন্যাসটি পড়ার পর থেকেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে গেল আমার প্রিয় লেখক। পাগলের মতো ওনার বইগুলি খুঁজে গেছি। আমাদের স্কুলের লাইব্রেরি ছোট। সব বই ছিল না। পরে খোঁজ পেলাম আমার গ্রাম থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরের এক বাজার রামপুরে একটি লাইব্রেরি আছে। সেখানে আমরা কয়েকজন বন্ধু গ্রাহক হলাম। স্কুলের পরিচয়েই আমাদের কার্ড দিল। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই কোশ্চেন পেপার, সহয়িকা এসব সিলেবাস ভিত্তিক বই তুলত। কিশোর-উপযোগী গল্প-উপন্যাস ছাড়া অন্য বই দিত না। লাইব্রেরিয়ান বলত, স্কুলকার্ডে সব বই পাওয়া যাবে না। যখন আঠারো বছর বয়স হয়ে যাবে, তখন বড়দের কার্ড করে দেবে। তবে বাড়ির কেউ পড়তে চাইলে বই নিয়ে যেতে পারি।

সুযোগ একটা পেয়ে গেলাম। মিথ্যে করে বাবা পড়তে চেয়েছে বলে, স্কুল কার্ড থেকেই অনেক বই তুলে আনতাম। পড়লাম পথের পাঁচালী, ইছামতী, অশনি সঙ্কেত, আরণ্যক, বনে-পাহাড়ে, হে অরণ্য কথা কও। বিভূতিভূষণের বন-জঙ্গল নিয়ে লেখা গল্প উপন্যাস গুলো আমাকে ভীষণ টানত। আরণ্যক আমার প্রিয় উপন্যাস। কত বার যে পড়েছি!পড়েছি আর মুগ্ধ হয়েছি। এমন বই আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রকৃতিকে দেখার চোখ খুলে গেল আরণ্যক পড়ে।

পড়ুয়া is a reader-supported publication. To receive new posts and support my work, consider becoming a free or paid subscriber.

আমাদের জেলা পাহাড়-জঙ্গলেই পরিবেষ্টিত। সোনামুখির অনেকটা অংশ জুড়েই শাল-মহুয়ার বন। মনে পড়ে ক্লাস নাইনে যখন উঠলাম, তখন আমার গ্রাম থেকে চার কিলোমিটার দূরে রামপুরে গোরা কাকুর কাছে টিউশন যেতাম। স্কুল না থাকলে টিউশন শেষে ভ্রমণ প্রিয় দু'একজন বন্ধুকে সঙ্গী করে হামিরহাটির জঙ্গলে ঢুকে পড়তাম। রামপুরের পরেই রেললাইন টপকে জঙ্গল। প্রথমে পড়বে জঙ্গল কেটে বানানো কতগুলো ঢেউখেলানো মাঠ, দূরে দূরে সাঁওতাল, মুন্ডা, মাহাতোদের গ্রাম। শীতের দিনে রেললাইন থেকে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে তাকালে মনে হতো, এ তো সেই লবটুলিয়া বইহার, আজমাবাদের অরণ্য-ভূমি। দিগন্তবিস্তৃত সারি সারি সরিষার খেতে হলুদ ফুল ফুটে আছে। ফুলের উগ্র সুবাস মন মাতাল করে তুলত। ওই দূরে হয়তো রাজুপাড়ে তার মহিষগুলি ছেড়ে দিয়ে গাছের তলে বসে পুঁথি পড়ছে। জঙ্গলের পাদদেশ একটা নীল রেখার মতো চলে গেছে শ্রীরামপুর, কোচডিহী, কুসুমকানালী, রপটগঞ্জ পেরিয়ে সোনামুখীর দিকে। ওখানেই তো পাহাড়ি রাজা দোবরু পান্নার রাজত্ব। পাহাড়ি কন্যা ভানুমতী কি এখনও বেঁচে?

জঙ্গলে বুনোহাতি, বন শুকুর, ময়ুর, খরগোশ এখনো আছে। খুব একটা নিরাপদ নয়। তবুও এডভেঞ্চারের নেশায় অনেক দূরদূরান্তে চলে যেতাম। আরণ্যকের সেই লাইনগুলো, বর্ণনাগুলো মনে পড়ত। চারপাশের প্রকৃতির সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করতাম। চৈত্রমাসে মহুয়া ফুল পড়ত বনে। বন-জঙ্গলের মানুষরা মহুয়া ফুলকে বলে 'মোল'। মোল পড়ার সময় ভোরেরবেলা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম মোল কুড়োতে। গ্রীষ্মের দাবদাহটাকেও উপভোগ করেছি। কী প্রচন্ড জলকষ্ট তখন। বনের মাঝে নালা-ডোবা, পুকুর, কাঁদর সব শুকিয়ে যায়। বিভূতিভূষণ যে জঙ্গলের বর্ণনা দিয়েছেন আরণ্যকে, সেই জঙ্গল তো আমার হামিরহাটির জঙ্গল, কোচডিহির জঙ্গল। কোনো তো অমিল খুঁজে পাই নি!

ধীরে ধীরে এমন নেশায় পড়লাম যে, বই হয়ে গেল আমার অবসর যাপনের, ভালো থাকার একমাত্র সঙ্গী। কত বই পড়লাম একে একে!শরৎ, মানিক, তারাশঙ্কর, অদ্বৈত মল্লবর্মণ। পদ্মানদীর মাঝি পড়ে বার বার চলে গেছি দামোদরে। নদী, নদীপাড়ের জীবন তখন আমাকে টেনে নিয়ে যেত।

সবসময় যে বই-ই পড়েছি, বাস্তবের মধ্যে সেই চরিত্রগুলিকে, সেই পরিবেশটাকে খুঁজে বেড়িয়েছি। একজন পাঠক হিসেবেই আমার সাহিত্যের জগতে প্রবেশ। আমি এখনও গর্ববোধ করি যে, আমি একজন পাঠক। পাঠক না হলে জগতের কত অজানা, অচেনা বিষয়ই যে অগোচরে রয়ে যেত!

Share this post

প্রিয় লেখক, প্রিয় বই ও সেই আলো-আঁধারির দিনগুলো

www.porua.net
Share
Previous
Next
Comments
Top
New
Community

No posts

Ready for more?

© 2023 Riton Khan
Privacy ∙ Terms ∙ Collection notice
Start WritingGet the app
Substack is the home for great writing