কিছুদিন আগে আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) কোভিড -১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। পুরোপুরি টিকা দেওয়া মানুষদের এখন আর মাস্ক পরা বা সামাজিক দূরত্ব অনুশীলনের দরকার নেই। যদিও আমরা এখনও মহামারীর মধ্যেই বাস করছি তবু মানুষ ১৪ মাসের এই কঠোর জীবনযাপনের পর একটু সুস্থিরতা পেলো। আমার মনে হয় মহামারীর প্রভাবটি পুরোপুরি বোঝার জন্য আমাদের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
২০২০ সালের ১৩ ই মার্চ, আমাদের এলাকার গ্রন্থাগারটি তাদের দরজা বন্ধ করার পরদিন, আমি আমার ব্যক্তিগত জার্নালে মহামারী দ্বারা সৃষ্ট "overwhelming anxiety” (অত্যধিক উদ্বেগ) সম্পর্কে কিছু কথা লিখে রাখি। আমি লিখেছিলাম, বই আমার কাছে সেরা অবকাশের উপায় এবং আমার নিজস্ব ব্যক্তিগত মেডিটেশন এই anxiety থেকে বাঁচার উপায়। আমার কাছে মনে হয়েছিল এটি একটি দুর্দান্ত ধারণা। গত ১৪ মাস ধরে (এবং এখনো) বাড়ির মধ্যে অস্থিরভাবে টেলিভিশনে খবরের পর খবর দেখার পর বই আমাকে শিথিল হতে সহায়তা করেছিল। যখন বই পড়ার সময় পেতাম না (যদিও প্রতিদিন চেষ্টা করতাম কিছু না কিছু পড়তে) তখন শরীর ও মনে একধরনের বিষন্নতা এসে ভর করতো। সত্যিকথা বলতে কি বইপড়া আমার কাছে ওষুদের মত কাজ করেছে। খুব দ্রুত আমি টের পেলাম যে এই অনুভূতি একান্তই আমার নয়, এমন মানুষের খোঁজ পেতে আমার বেশি দেরি হয়নি (ধন্যবাদ বইয়ের হাট)।
অবশেষে আমরা সকলেই বইয়ের কাছে ফিরে আসার পথ এবং বই যে সান্ত্বনা দিতে পারে সেটি বুঝতে পেরেছি। এবং এটি কেবল এই কারণে নয় যে আমি বই পছন্দ করি, আমার মত অনেকের বিশ্বাস যে বইপড়া আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান দিতে পারে। বইপড়া আমাদের আরও ভাল বোধ করতে সাহায্য করার কয়েকটি উদাহরণ দেই।
আগেই বলেছি, বইপড়া দুর্দান্ত চাপ থেকে আমাদের মুক্ত রাখে। এমনকি দিনে পাচঁ মিনিট পড়লেও স্ট্রেসের মাত্রা হ্রাস হতে পারে। নিউইয়র্কার পত্রিকা ২০১৫ সালে জানিয়েছিল যে "বইপড়া আমাদের মস্তিষ্ককে আনন্দের অনুরূপ একটি অভিজ্ঞতার রাজ্যে নিয়ে যায়, শরীর ও মনে অভ্যন্তরীণ শান্তি বয়ে নিয়ে আসে। আমার মনে হয়, বইপড়া আমাদের আরও সহানুভূতিশীল হতে সাহায্য করে। ২০১১ সালের মনোবিজ্ঞানের বার্ষিক পর্যালোচনায় প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে মানুষ যখন কোনও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে পড়ে, তখন তাদের মস্তিষ্ক ঠিক তেমনভাবে উদ্দীপিত হয়। বইয়ের চরিত্রের অভিজ্ঞতাগুলো অনুভব করার জন্য আমরা যখন বইপড়ি তখন আমরা আমাদের মস্তিষ্কের সেই একই অংশগুলো ব্যবহার করে বুঝতে চেষ্টা করি। আমেরিকার বিজ্ঞান জার্নাল ২০১৩ সালে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছিল যেখানে দেখা যায় যে কথাসাহিত্যের পাঠকদের মধ্যে সামাজিক উপলব্ধি এবং সহানুভূতির পরিমাপ বেশি পাওয়া যায়। বইপড়া আমাদের বাসা থেকে বের না হয়েই ভ্রমণের অনুভূতি দেয় যা লকডাউনের সময় আমার কাছে আরও গুরুত্ব সহকারে ধরা দেয়। ইতিবাচক এবং শক্তিশালী অনুভূতির জন্য বইয়ের উপযোগিতা অনস্বীকার্য। বইপড়ার জন্য এখন বেশি খরচও করতে হয় না। মহামারী চলাকালীন প্রচুর মানুষ তাদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন সুতরাং কম খরচে বা বিনাখরচে বইপড়া একধরনের মানসিক স্বস্তি। আমাদের এখানে সেপ্টেম্বর ২০২০ দিকে লাইব্রেরি কর্মীদের লাইব্রেরিতে আসার অনুমতি দেওয়ার সাথে সাথে গ্রন্থাগারগুলো তাদের “কার্বসাইড পিকআপ” প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমার মতো পড়ুয়াদের বইপড়ার ব্যবস্থা করে দেয়। যখন চারিদিকে সবকিছু বন্ধ, তখন বই-ই কোনো না কোনও ফর্মে অবাধে পাওয়া যেতে থাকে। এক্ষেত্রে ইবই এর অবদানও অনস্বীকার্য।
বইয়ের মাধ্যমে অন্যান্য পাঠকদের সাথে সংযোগ হওয়াটা আমার জন্য একটি খুব মনোরম অভিজ্ঞতা। বইয়ের হাট এবং আরও কয়েকটি অনলাইন ইংরেজি বুক গ্রুপের মাধ্যমে, আমি সারা বিশ্বের বিভিন্ন পাঠকদের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি। নিয়মিত বই এবং বইয়ের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করাটা সত্যই আনন্দদায়ক, যদিও এসব পড়ুয়া বন্ধুদের সাথে আমি কখনও সাক্ষাত করতে পারি নি, তবু তাদের সাথে পরিচিত হয়ে আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছি, এবং এটি কেবলমাত্র ইন্টারনেট-সক্ষম পদ্ধতিতে সম্ভব হয়েছে।
এবং পরিশেষে যদি বলি যে বইপড়া আমাদের রাতে আরও ভাল ঘুমাতে সহায়তা করে। আমি নিশ্চিত যে, নেটফ্লিক্সে কিছু দেখার চেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার আগে যদি আমি কমপক্ষে ৩০ মিনিটের জন্য বইপড়ি তবে আমার ঘুমটা আরও গভীর হয়। রাতে ভালো ঘুমের পরে সকালটা আরও আনন্দদায়ক মনে হয়।
আমি এখন পড়ছি অমর্ত সেনের স্মৃতিকথা “Home in the World”. আমি বইটির প্রায় অর্ধেক পথে। স্থানীয় একটি লাইব্রেরির বুক ক্লাবের জুলাইয়ের সভার জন্য প্রস্তুতির অংশ হিসাবে বইটি পড়ছি, সেখানে আমরা মিঃ সেনকে নিয়ে আলোচনা করব। বইটির একেকটি অধ্যায় আমাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং পরের সময়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দিচ্ছে, যেখানে সেন তার আলোকিত বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের এক মুদ্ধময় গল্প শোনাচ্ছেন। সেন বই পড়তে এবং আলোচনায় অংশ নিতে পছন্দ করেন। তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন “..কেমব্রিজের সেই দিনগুলোতে, যখন ভারত সোসাইটি বা পাকিস্তান সোসাইটি বলে কিছু ছিল না, তখন একটি সমৃদ্ধ ‘মজলিস’ (ফারসি ভাষায় শব্দটির অর্থ সমাবেশ) ছিল যা সমস্ত দক্ষিণ এশীয়দের স্বাগত জানিয়েছিল। আমার ঘনিষ্ঠদের অনেকেই মজলিসের অন্তর্ভুক্ত ছিল, পূর্ব পাকিস্তান (পরে বাংলাদেশ) থেকে রেহমান সোবহান এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাহবুব উল হক এবং আরিফ ইফতেখার (আমার জানামতে সেরা বিতর্ককারী)। দ্বিতীয় বছর থেকে মজলিস আমার জীবনের একটি কেন্দ্রীয় অংশ হয়ে উঠল এবং রেহমান সোবহানকে আমি মজলিসের সভাপতি হিসাবে পেয়েছি, এবং ধীরে ধীরে রেহমান আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে ওঠে, ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের ক্রমাগত একত্রে আনতে মজলিসের গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা ছিল”। বইয়ের হাটের মাধ্যমে এমন অভিজ্ঞতা আমারও কমবেশি হয়েছে, ওদের মজলিস আর আমাদের হাট! বইপড়া এবং আলোচনা আমাকে একই সাথে সময় এবং নানান স্থানে যাওয়ার একটি পরিবহন ব্যবস্থা, এবং সে কারণে, এটি আমাকে তুমুল আনন্দ দেয়। আমি বই ও বইয়ের হাটের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।