রবীন্দ্রনাথের বই-ভাবনা
শুধু পাঠক লাইব্রেরিকে তৈরি করে তা নয়, লাইব্রেরি পাঠককে তৈরি করে তোলে। লাইব্রেরিয়ানের গ্রন্থবোধ থাকা চাই, কেবল ভাণ্ডারী হলে চলবে না। আধুনিক বইবিজ্ঞানের এইটিই প্রধান ভিত্তি।
মানুষের উপলব্ধির একমাত্র ধারক ও প্রসার কেন্দ্র বই ও লাইব্রেরি। বইয়ের মধ্যে মানুষ ‘অতীতকে বর্তমানে বন্দী' করে রাখে, এবং বর্তমানকে ভবিষ্যতের দিকে প্রসারিত করে দেয়। রবীন্দ্রচিন্তায় বইয়ের এই স্থিতিশীল অথচ চলমান রূপটি প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ১৮৮৬ সালে লিখছেন, “মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহানন্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।”
বই নিয়ে লেখাঃ বই পড়ার স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, বইয়ের আলোচনা, প্রবন্ধ এবং বই নিয়ে আরও অনেক কিছু। আপনিও পড়ুয়া'য় লিখুন। আমাদের কাছে লেখা পাঠাবার ঠিকানা editor@porua.net
লাইব্রেরিতে বই সংগ্রহের স্বরূপ কেমন হবে সে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “এখানে জীবিত ও মৃত ব্যক্তির হৃদয় পাশাপাশি এক পাড়ায় বাস করিতেছে, বাদ ও প্রতিবাদ এখানে দুই ভাইয়ের মতো একসঙ্গে থাকে, সংশয় ও বিশ্বাস, সন্ধান ও আবিষ্কার এখানে দেহে দেহে লগ্ন হইয়া বাস করে।” লাইব্রেরির সংগ্রহে সব বিষয়ের বই তো থাকবেই, একই বিষয়ের বিভিন্ন মতবাদের বইও থাকবে পাশাপাশি। কোনো বিশেষ দল বা বিশেষ মতবাদের প্রতি পক্ষপাত থাকবেনা লাইব্রেরিয়ানের, ব্যক্তিগত চিন্তায় থাকলেও লাইব্রেরি নির্মাণে তাঁকে হতে হবে নিরপেক্ষ। সর্বশ্রেণীর এবং সর্ববিধ মত ও পথের বই সংরক্ষিত হবে লাইব্রেরিতে, যাতে একই বিষয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে অনুসন্ধিৎসু পাঠক চিন্তা করতে পারেন। লাইব্রেরির জন্য বই বাছাই-এর এই মূলনীতি আজকাল লাইব্রেরিয়ান মাত্রই জানেন। একথাও জানেন যে, এই সংগ্রহ নিপুণভাবে করতে হবে যাতে অবান্তর বই লাইব্রেরিকে অযথা ভারাক্রান্ত না করে। ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, "অধিকাংশ লাইব্রেরিই সংগ্রহ বাতিকগ্রস্ত। তার বারো আনা বই প্রায়ই ব্যবহারে লাগে না, ব্যবহারযোগ্য অন্য চার আনা বইকে এই অতিস্ফীত গ্রন্থপুঞ্জ কোণঠাস৷ করে রাখে।" অর্থাৎ এমন বই দিয়ে লাইব্রেরি ভরে তুলতে হবে যেগুলি পাঠকদের কাজে লাগবে, অকেজো বই চটকদার অথবা নামকরা হলেও যদি ব্যবহারে না লাগে তো শুধু শুধু শোভাবর্ধনের জন্য রাখা অর্থহীন। কেননা সব বই সব লাইব্রেরির উপযুক্ত নয়।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাগারিক ড. এস. আর. রঙ্গনাথন তাঁর গ্রন্থবিজ্ঞানের পঞ্চনীতির প্রথমেই বলেছেন, ‘Books are for use,' বই ব্যবহারের জন্য। ড. রঙ্গনাথন তার পঞ্চনীতিতে স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়েছেন –
সব বই ব্যবহারের জন্য।
প্রত্যেক পাঠকের জন্যই বই রয়েছে।
প্রত্যেক বইয়েরই পাঠক রয়েছে।
পাঠকের সময় বাঁচানো অবশ্যকর্তব্য।
সর্বোপরি গ্রন্থাগার একটি বর্ধনশীল সংস্থা।
সংগ্রহের পূর্বে পাঠক-গোষ্ঠীর মান অনুযায়ী বইয়ের পাঠযোগ্যতা ও পাঠ-সম্ভাবনীয়তা বিবেচনা করে দেখা কর্তব্য। দেশে বিদেশে এমন লাইব্রেরির অভাব নেই যেগুলি কেবলমাত্র বইসংখ্যার কৌলিন্যে আভিজাত্য দাবী করে; অথচ এমন লাইব্রেরিই অভিজাত যার বাছাই করা পরিমিত সংগ্ৰহ উচ্চস্তরের।
“লাইব্রেরিকে ব্যবহারযোগ্য করতে গেলে লাইব্রেরির পরিচয় সুস্পষ্ট ও সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ হওয়া চাই।” রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের লাইব্রেরির বিশেষ বিশেষ দিক সম্পর্কে আভাস পাই। বইয়ের-তালিকা সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের চিন্তার ধারা লক্ষণীয়। “সাধারণত লাইব্রেরি বলে থাকে, আমার গ্রন্থতালিকা আছে, স্বয়ং দেখে নেও, বেছে নেও। কিন্তু তালিকার মধ্যে আহ্বান নেই, পরিচয় নেই। তার তরফে কোনো আগ্রহ নেই। যে লাইব্রেরির মধ্যে তার নিজের আগ্রহের পরিচয় পাই, যে নিজে এগিয়ে এসে পাঠককে অভ্যর্থনা করে আনে, তাকেই বলি বদান্য—সেই হল বড় লাইব্রেরি—আক্বতিতে নয় প্রকৃতিতে।”
রবীন্দ্রনাথের আরেকটি উক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। “শুধু পাঠক লাইব্রেরিকে তৈরি করে তা নয়, লাইব্রেরি পাঠককে তৈরি করে তোলে।” এতে একদিকে যেমন লাইব্রেরির তরফে ‘আহ্বান' জানানোর কথা আছে অন্যদিকে তেমনি আছে লাইব্রেরি তথা লাইব্রেরিয়ানের গুরু দায়িত্বের কথা। রঙ্গনাথন তাঁর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গ্রন্থনীতিতে বলেছেন 'প্রত্যেক পাঠকের জন্যই বই রয়েছে’ এবং ‘প্রত্যেক বইয়েরই পাঠক রয়েছে' অর্থাৎ প্রত্যেক পাঠককে দিতে হবে পছন্দমতো বই এবং প্রতিটি বইয়ের জন্যই থাকবে এক বা একাধিক পাঠক।
পাঠক তাঁর চাহিদা দিয়েও লাইব্রেরিকে তৈরি করে তোলে। লাইব্রেরি প্রতিটি বইয়ের জন্য ‘আহ্বান' জানিয়ে ‘তৈরি’ করে তোলে পাঠক সম্প্রদায়। আধুনিক লাইব্রেরিয়ানরা জানে কিভাবে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের বইয়ের পাশে অনুরূপ বিষয় সংক্রান্ত আরো বই রেখে, এবং পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার অন্যান্য উপায় অবলম্বন করে পাঠকদের আগ্রহ বাড়াতে হয় এবং একটি পাঠকগোষ্ঠী গড়ে তুলতে হয়। শুধু তাই নয় পাঠকের রুচির পরিবর্তন বা রুচির গঠনও এই উপায়ে সম্ভব। পাঠক-সাধারণের রুচি গঠনের সামাজিক দায়িত্ব আংশিকভাবে লাইব্রেরিয়ানের উপর বর্তায়।
বইয়ের রুচি সংরক্ষণ এবং বিদ্যানুগ বিশ্লেষণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সচেতন। “লাইব্রেরিয়ানের গ্রন্থবোধ থাকা চাই, কেবল ভাণ্ডারী হলে চলবে না।” আধুনিক বইবিজ্ঞানের এইটিই প্রধান ভিত্তি। সমস্ত বই-জগতেরই শুধু নয়, অধীত বিদ্যার প্রত্যেক শাখা সম্বন্ধেই লাইব্রেরিয়ানের জ্ঞান থাকা চাই। এই জ্ঞানের প্রয়োগে পাঠকদেরকে সাহায্য এবং, এমন কি, ক্ষেত্র বিশেষে পরিচালনা করার যোগ্যতাও লাইব্রেরিয়ানের থাকা চাই। 'গ্রন্থবোধ’ থেকে তিনি বইয়ের ভালমন্দ এবং সেই সেই বইকে ভিত্তি করে সামাজিক ভালমন্দ যাচাই করে যেন নিতে পারেন। এই বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের সূক্ষ্ম দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। তিনি মনে করেন “প্রত্যেক লাইব্রেরির অন্তরঙ্গ সভ্যরূপে একটি বিশেষ পাঠকমণ্ডলী থাকা চাই।” এবং আশা করেছেন লাইব্রেরিয়ান “এই মণ্ডলীকে তৈরী করে তুলে একে আকৃষ্ট করে রাখতে” পারবেন ; কেননা “তার উপরে ভার কেবল গ্রন্থগুলির নয়, গ্রন্থ পাঠকের।”
রবীন্দ্রনাথের বই-ভাবনার আরেকটি দিকও আছে। তিনি বলেছেন, “লাইব্রেরির মুখ্য কর্তব্য গ্রন্থের সঙ্গে পাঠকদের সচেষ্টভাবে পরিচয় সাধন করিয়ে দেওয়া, গ্রন্থ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ তার গৌণ কাজ।” 'সচেষ্টভাবে' গ্রন্থের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিতে হলে বইয়ের আভ্যন্তরীণ পরিচয়ও লাইব্রেরিয়ানের নিজের থাকা প্রয়োজন। আধুনিক বইবিজ্ঞান লাইব্রেরিয়ানের এই গুণটির উপরে জোর দেয় সবচেয়ে বেশি, এবং এজন্য বইয়ের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ পারিচয়, অর্থাৎ bibliography, এবং সর্বসাধারণকে পাঠের ব্যাপারে সক্রিয় সহায়তা, অর্থাৎ reference-এর কাজে দীক্ষিত হতে হয়। ‘গ্ৰন্থ সংগ্ৰহ ও সংরক্ষা' লাইব্রেরিয়ানের পক্ষে ‘গৌণ কাজ' হ'লেও সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ উদাসীন ছিলেন না। “লাইব্রেরি তার যে অংশে মুখ্যত জমা করে সে অংশে তার উপযোগিতা আছে, কিন্তু যে অংশে সে নিত্য ও বিচিত্রভাবে ব্যবহৃত সেই অংশে তার সার্থকতা।” লাইব্রেরিতে শুধুমাত্র ব্যবহারযোগ্য বইয়ের সমাবেশই এই বক্তব্যের মূল লক্ষ্য নয়, স্বল্প ব্যবহৃত অথচ অপরিহার্য বই কখনো ব্যবহারে লাগতে পারে মনে করেও লাইব্রেরিতে সমাবিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ ‘গ্রন্থবোধ’ সম্পন্ন গ্রন্থাধ্যক্ষ সুনিপুণভাবে এই দুই দিক বজায় রেখে বই নির্বাচনের কাজ করবেন এবং ‘সচেষ্টভাবে' তাঁর ‘পাঠকমণ্ডলীর’ কাছে সেগুলির ‘পরিচয় সাধন' করিয়ে দেবেন। লাইব্রেরিয়ানকে একাধারে গ্রন্থাধ্যক্ষের ও পাঠকের কাজ করতে হবে। “আতিথ্য পালনের” সঙ্গে সঙ্গে তিনিও নেবেন স্ব-প্রবর্তিত আতিথ্যের স্বাদ। সেইখানেই তাঁর পরিপূর্ণ শিক্ষা ও যোগ্যতা।