শিমুল রঙের গ্রন্থস্মৃতি
মোয়াজ্জেম হোসেন সম্রাট | শহরে আত্মীয়স্বজনের বাসায় কালেভদ্রে বেড়াতে গিয়ে ডিস চ্যানেলে ঠাকুরমার ঝুলি দেখেছি, তবে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের নাম আমি প্রথম শুনি এই প্রবন্ধের টীকা অংশে।
১
স্কুলে আমাদের বাংলা পাঠ্যবইয়ে "পল্লীসাহিত্য'' নামে দারুণ সুখপাঠ্য একটি প্রবন্ধ ছিল। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা। আমার খুব পছন্দের ছিল প্রবন্ধটি। প্রিয় একটি বাক্য ছিল প্রবন্ধের শুরুতেই, "পল্লীর মাঠে ঘাটে, পল্লীর আলো বাতাসে, পল্লীর প্রত্যেক পরতে পরতে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে। কিন্তু বাতাসের মধ্যে বাস করে যেমন ভুলে যাই বায়ু-সাগরে আমরা ডুবে আছি, তেমনি পাড়াগাঁয়ে থেকে আমাদের মনেই হয় না যে কত বড় সাহিত্য ও সাহিত্যের উপকরণ এখানে ছড়িয়ে আছে।"
শহরে আত্মীয়স্বজনের বাসায় কালেভদ্রে বেড়াতে গিয়ে ডিস চ্যানেলে ঠাকুরমার ঝুলি দেখেছি, তবে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের নাম আমি প্রথম শুনি এই প্রবন্ধের টীকা অংশে।
টীকার তথ্য ও ক্লাসে বাংলা ম্যাডামের মুখে শোনা গল্প দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সৃষ্টিসমগ্র আস্বাদন করার জন্য আমাকে ব্যগ্র করে তুললো। তবে গ্রাম থেকে প্রায় ২০ কিলো দূরে বরিশাল শহরে যাতায়াতের অসুবিধা, কিশোর বয়সে স্ব-উদ্যোগে বই কেনার মতো অর্থ অপর্যাপ্ততা, এবং সেসময়ে পাঠ্যবহির্ভূত বইপাঠে অভিভাবকীয় অননুমোদন -সবমিলিয়ে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার সৃষ্টিসমগ্র সংগ্রহ ও পাঠ আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
কালক্রমে হয়তো সেই ইচ্ছা ধূসরও হয়ে গিয়েছিল। চার বছর পরে ২০১১ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষা দিচ্ছি। গ্রামে বাড়ির পাশের কলেজেই পড়াশুনা করেছি। পরিক্ষাকেন্দ্র শহরে। বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে। প্রায় একমাসব্যাপী তত্ত্বীয় পরিক্ষা শেষ হলে একদিন ব্যবহারিক পরিক্ষার জন্য কিছু সহায়ক বই ও ব্যবহারিক খাতা কেনার জন্য সদর রোডের এক বইয়ের দোকানে গেলাম। সেই বয়সে অতি প্রয়োজন ছাড়া শহরে যাওয়া হতো না। বছরে ৩-৪ বার হয়তো যেতাম। শহরে গেলে বই কেনার উদ্দেশ্য ও অর্থ না থাকলেও বইয়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোকানের সেলফে সাজানো বই দেখতে ও হাতে নিয়ে বই খুলে বিনা পয়সায় খানিকক্ষণ চোখ বুলাতে বিপুল আনন্দ ও আগ্রহ ছিল আমার। সেদিন বই দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল একটি বইয়ে। শরীরে বিদ্যুৎ চমকে যাওয়ার মতো অনুভব করলাম। পুরনো প্রেমিকার সাথে বহুদিন পরে হঠাৎ দেখা হওয়ার মতো অপরিমিত পুলক। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার রচনাসমগ্র। মোড়কে তাঁর ছবিসহ। অখন্ড।
দোকানের এক কর্মচারীকে দ্রুত বললাম, ভাই, ঐ বইটা দিন।
খুব যত্ন নিয়ে, গভীর ভালোবাসায় আলতো করে বইটির কাভার খুললাম।সূচিপত্র খুলে দেখলাম, ভেতরে পল্লীসাহিত্যের অমূল্য রত্নরাজি। শিশুতোষ সাহিত্যের খনি।
রাজপুত্র, রাজকন্যা আর পাতালপুরির গল্প। হৃদয়হরা, মনকাড়া। রাক্ষস, খোক্কস আর শাকচুন্নির ভয়ধরানো গল্প।কি বাহারি নাম প্রতিটি গল্পের! নাম দেখে বুঝলাম, কিছু কিছু গল্প স্কুলের বাংলা সহপাঠ বইয়ে পড়ে এসেছি।
ঠাকুরমার ঝুলি, কলাবতী রাজকন্যা, সাত ভাই চম্পা, দুধের সাগর, কাঞ্চনমালা, কিরণমালা, ডালিম কুমার, চিরদিনের রূপকথা, হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী, শঙ্খমালা আরো কতশত গল্প সে বইয়ে!
দাম জিজ্ঞেস করে জানালাম, আড়াইশো টাকা। কিন্তু এখন যে এই বই কেনার মতো এত টাকা নাই। অগত্যা বই না কিনেই ব্যবহারিক বই ও খাতা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
দিন পাঁচ-সাত পরে ব্যবহারিক পরিক্ষা শুরু হলো। দুদিনে চারটি বিষয়ের পরিক্ষা হবে। তত্ত্বীয় পরিক্ষা শহরে বড় খালার বাসায় থেকে দিয়েছিলাম। ব্যবহারিক পরিক্ষা বাড়ি থেকে গিয়ে দিবো।
গাড়িতে যাতায়াত ভাড়া এবং পরিক্ষাশেষে দুপুরে খাবারের জন্য বাড়ি থেকে দৈনিক আড়াইশো টাকা বরাদ্দ ছিলো। প্রথমদিনের পরিক্ষা শেষে দুরু দুরু বুকে সদর রোডে সেই বইয়ের দোকানে গেলাম, ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি, কাঙ্ক্ষিত বইটির সন্ধানে। এতদিনে বিক্রি হয়ে গেল কিনা। চার বছর পর খুঁজে পেয়েও হারিয়ে ফেললাম কিনা। না, ভাগ্য সহায়। পেলাম। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম, কালকে বিকাল পর্যন্ত যেন বইটি বিক্রি না হয়।
পরিক্ষা শেষে ভাত খাবার জন্য বরাদ্দ টাকা বাঁচিয়ে চরকাউয়া এসে একটি সস্তার খুপড়ি দোকানে পাঁচ টাকা দামের দুটি কিমা পুরি সাথে মাছের ফ্রি ঝোল দিয়ে দুপুরবেলার আহার সারলাম। রিকশা আর খাবার টাকা খরচ না হওয়ায় প্রথম দিনে দেড়শো টাকাই বেঁচে গেল।
বাড়িতে ফিরে আসার সময় সারাটা পথ এই ভেবে পুলকিত হয়েছি যে আগামীকালই বইটি আমার হচ্ছে। একান্তই আমার।
সারারাত পরিক্ষার প্রস্তুতি ও দুশ্চিন্তার চেয়ে আগামীকালই পল্লীসাহিত্যের এক অমূল্য রত্নরাজির মালিক হচ্ছি এই কল্পনায় আপ্লুত হলাম।
পরদিন সকাল। সেদিনের বরাদ্দ আড়াইশো টাকা ও আগের দিনের বেঁচে যাওয়া টাকা নিয়ে বরিশাল রওনা দিলাম। কখন পরিক্ষা শেষ হবে, কখন সদর রোডে ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরিতে যাবো, পরিক্ষা মাঝে এই ক্ষণ গণনায় উত্তেজিত হচ্ছি। বিকাল আড়াইটা- তিনটায় পরিক্ষা শেষ হলো। পরিক্ষাকেন্দ্র থেকে সদর রোডের ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি ছিল মিনিট দশেকের হাঁটাপথ। কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে বাহাদুর শাহ সড়ক ধরে জিলা স্কুল হয়ে সোজা ছুটলাম সদর রোডের দিকে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের খোঁজে। বিক্রি হয়ে যাওয়ার ভয়ে। চাতক পাখির মতো এক সপ্তাহ ধরে প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষা করা তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের আকুতি ঝর্ণার শীতল পানিতে শান্ত করতে।
প্রায় চার বছর পরে বহু কষ্টেসৃষ্টে পাওয়া বইটি দশ বছর ধরে আমার বইয়ের আলমারিতে অনেক যত্ন, স্নেহ ও ভালোবাসায় এখনো দাঁড়িয়ে আছে থরে বিথরে সাজানো আরো অনেক বইয়ের সাথে।
২
সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গেলাম মামাবাড়ি কর্ণকাঠীতে। ২০০৭ সাল। ক্লাস নাইনে পড়ি।
আমি ছোটবেলা থেকেই গ্রন্থকীট। কারো বাড়িতে কোথাও বেড়াতে গেলে দেখতাম সে বাসায় বই আছে কিনা। সময় কেটে যেতো বই পড়ে। মামাদের শালঘরে অনেক পুরনো একটা স্টিলের আলমারি ছিলো। আলমারির উপরে ছিল পাঁচমিশালি অনেক বই। গল্প, উপন্যাসের বই, মামাদের সময়ের বাংলা পাঠ্যবই ছাড়াও আরো অনেক। মামাদের কেউ কেউ গল্পের বই পড়তেন। দুই ক্লাস বড় মামাতো ভাই রাশেদ ভাইয়াও সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন।
আলমারির উপর হাতড়ে ওখানে একটা নতুন বই পেলাম। নাম "কেমন তোমার ভালোবাসা"।লেখক ইমদাদুল হক মিলন। কেবল নাইনে উঠেছি। খেয়াল করছি, বসন্ত বিকেলের বাতাসে মন কেমন কেমন করা একটা অনুভূতি হয়। বইয়ের নামই সেই কেমন কেমন করা অনুভূতিকে যেন উস্কে দিল।
একাকী নিরিবিলি একটি রুমে বইটা নিয়ে পড়তে বসলাম। ট্র্যাজেডি, পিলে চমকানো টুইস্ট ও মৃদু সাইকোলজির প্লটে বইটি রুদ্ধশ্বাসে এক বসায় যেখানে এসে শেষ হলো, দেখি সেটি বইয়ের প্রথম খণ্ড।
রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে যে ছবি, যাকে পাগলের মতো ভালোবাসত খালেদ, যার মৃত্যুতে ভারসাম্য হারিয়ে পথে ঘুরছে খালেদ, কিছুদিন পরে সেই ছবি ফিরে এসেছে আবার। তাকে খালেদ চিনতে পারলেও ছবি খালেদকে চিনতে পারছে না। কেন ছবি খালেদকে চিনতে পারছে না? শহরের ছবি গ্রামে আসলো কীভাবে? সবাইকে ছেড়ে অন্যের বাড়িতে কীভাবে থাকছে?
কাহিনির উন্মাতাল নেশায় দ্বিতীয় খণ্ড খুঁজতে শুরু করলাম। আবার সেই আলমারির উপরে। না, সেখানে নেই।
পড়ার টেবিল, বইয়ের তাক, ঘরের খাট, তোষকের নিচ, পাশের বাসা কোথাও খোঁজা বাকি রাখলাম না। কিন্তু, পেলাম না।
ছুটি শেষ হয়ে এল। অপূর্ণতা ও বিষণ্নতায় পাথরভার মন নিয়ে মামাবাড়ি থেকে বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু বইটির মোহ থেকে মুক্ত হতে পারলাম না।
২০০৭ -২০১১ যতবার বাড়ি থেকে বরিশাল শহরে যেতে হয়েছে, তখন বছরে ৩-৪ বারের বেশি বরিশাল যাওয়া হতো না, এমন কোনো বার হয়নি যে সদর রোডের বইয়ের দোকানগুলোতে একবার ঢুঁ মেরে জিজ্ঞেস করিনি, মিলনের "কেমন তোমার ভালোবাসা" বইটি আছে কিনা। কিন্তু প্রতিবারই আশাহত হয়েছি।
২০১২ সালে বন্ধু, সহপাঠী ও বরিশালে বাংলাবাজার খাদেম হোসেন সড়কে সেসময়ের মেসমেট জহির ঢাকা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষা দিতে। ওকে বলে দিয়েছিলাম বইটি পায় কিনা দেখতে। শুনেছি, যত পুরনো হোক, এমন কোনো বই নেই, যা নীলক্ষেত- বাংলাবাজারে পাওয়া যায় না।
জহির পরিক্ষা শেষে নীলক্ষেত তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বইটি পেল না। দিনশেষে বইটি পাওয়া গেলো নিউমার্কেটে। 'গ্রন্থকলি' বইয়ের দোকানে।
প্রথম সাক্ষাতের ৫ বছর পর ২০১২ সালের শেষে এসে পুরো ৩ পর্বের অখণ্ড বইটি আমার হাতে পেলাম। জহির নিজের টাকা দিয়েই কিনেছিলো। বই নিয়ে বরিশাল আসার পর আমিও বইয়ের টাকা দেইনি।
থাক না বইটির বহু স্মৃতির সাথে বন্ধু হিসেবে ওরও স্মৃতি জড়িয়ে!