

Discover more from পড়ুয়া
প্রমথ চৌধুরীর একটি উক্তির আলোকে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি। "সাহিত্যের তত্ত্বজ্ঞানের সাহায্যে সাহিত্য রচনা করা যায় না। আগে আসে বস্তু, তার পরে তার তত্ত্ব। শেষটি না থাকলেও চলে, কিন্তু প্রথমটি না থাকলে সাহিত্যজগত শূন্য হয়ে যায়। সাহিত্যস্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির পালা শেষ করে অতীতকালে চলে গেছেন। এবার তত্ত্ববােদ্ধা তাঁর ব্যাখ্যা করে যাবেন অনন্তকাল"।
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে’। আর সেই প্রথম উপন্যাসই তার পথ করে দিয়েছিলো। তাকে শক্তিমান কথাশিল্পী হিশেবে চিনতে পেরেছিলেন পাঠকসমাজ। সমালোচকেরাও আশান্বিত হওয়ার মতন লক্ষণাদি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর লেখায়। অনলসভাবে লিখে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। হতাশ করেননি তাঁর পাঠক-পাঠিকাদের।
আমাদের মনে রাখতে হবে ‘সব লেখা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থায়ী আসন পায় না তবে, পাঠকের ভালো লাগাতে পারাটাও কম কৃতিত্বের ব্যাপার নয়’। গল্প বলার দক্ষতা ছিল তাঁর। এ দক্ষতার কারনে পাঠক-পাঠিকাদের জয় করে নিয়ে ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। জনপ্রিয়তা তাকে ফুলটাইম লেখক হতে বাধ্য করেছিল। পাঠকই তাকে সাহসী করে তুলেছিল বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকুরিতে ইস্তফা দিতে দ্বিধা হয়নি তার। আসলে লেখকের ধর্ম যে লেখা তা প্রমাণ করলেন এই বিরল পাঠকের দেশে হুমায়ূন আহমেদ।
আমাদের সাহিত্যে তাঁর বই বেস্টসেলারের মর্যাদা পেয়েছিল, ছিল কি এখনো আছে। সুতরাং তিনিই পাঠকের মনোরঞ্জনকারী উপন্যাসের সফল নির্মাতা ছিলেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে জনপ্রিয় উপন্যাসিক বিমল মিত্রের বক্তব্য, “স্বীকার করতেই হবে যে পাঠকের জন্যে সাহিত্য নয়, বরং সাহিত্যের জন্যেই পাঠক সুতরাং আজকালকার কোনও সৎ লেখকের পক্ষে পাঠকের সম-স্তরে নেমে আসবার কোনও প্রশ্নই আসে না।” এবং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্যটিও প্রণিধানযোগ্য। যেমন, উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু একটা ব্যক্তি-চরিত্র থাকে তো থাকুক- তার বৃত্তটা হবে সমাজব্যাপী। কিন্তু এর ফলে কি ব্যক্তির মূল্য অস্বীকৃত হবে? সে সম্ভাবনা নিশ্চয়ই নেই। আজ পৃথিবীর সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে - ব্যক্তির সীমানা বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। অর্থনীতি সমাজনীতির সঙ্গে মনের ভৌগোলিক পরিধি বেড়ে গেছে। সেই বৃহত্তর পটভূমিই তো আজকে ব্যক্তি-মানবের স্বাধিষ্ঠানক্ষেত্র। একক মানুষের কোনো সমস্যাকেই এই পটভূমি ছাড়া সমাধান করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। শরীর, মন, মনুষ্যত্ব আর সংস্কৃতির যে কোনাে ক্ষুধাই আজ এই সামগ্রিক সমাধানে নিবৃত্তি লাভ করতে পারে।
হুমায়ূন আহমেদ অভিনিবিষ্ট পাঠক চরিত্রাবলী এবং কাহিনীর বিপুলতার মধ্যে এই সবের সন্ধান পাবেন আশা করি। সংসারের মধ্যে বেঁচে থেকে মনুষ্যত্বের বিকাশ সম্ভব, আনন্দ মরীচিকা মাত্র নয়। আনন্দ তার প্রবহমানতা নিয়ে সাহিত্যে সমুপস্থিত এরই সঙ্গে যুগলক্ষণে চিহ্নিত মনস্বিতা বিরাজমান। আমাদের সমস্ত সুখদুঃখ, আশানিরাশা রূপলাভ করে চলেছিল তার রচনায় চলচ্ছবি হয়ে।
হুমায়ূন আহমেদের মা আয়শা ফয়েজ তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছেন এই কথাগুলো,
"পাঠকের অনেকেই হয়তো জানেন, হুমায়ূন আহমেদ ওর নিজের প্রথম লেখাটাকে নিজের লেখা বলে মানতেই নারাজ। চট্টগ্রামে থাকাকালে ওর স্কুল ম্যাগাজিনে ওর প্রথম যে লেখাটি ছাপা হয়েছিল, সেটি ওদের বাবা তিন দফা সংশোধন করে দিয়েছিল। তবে, ওই ঘটনার অনেক বছর পর ওর বাবা ছেলের প্রথম উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়ে আবার নিজের লেখাই ছেলেকে দিয়েছিল সংশোধন করে দেওয়ার জন্য, ছেলে সেই লেখা কেটেকুটে এমন একটা জিনিস বানাল, যা আসলে ওর বাপের লেখার থেকে অনেক দূরে চলে গেল। ওই লেখাটা ছিল একটা নাটক, যার নাম ওর বাবা রেখেছিল ‘কত তারা আকাশে’। তখন আমরা পিরোজপুরে থাকি। ঢাকা বেতারের এক প্রডিউসারের বাড়ি ছিল পিরোজপুরে। প্রডিউসারের সাথে ওর বাবার আলাপ হয় এবং তিনি আশ্বস্ত করেন যে, ভালো নাটক লিখতে পারলে তিনি সেটা বেতারে প্রচারের ব্যবস্থা করবেন। তাই সে লিখে ফেলল ‘কত তারা আকাশে’। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়ে তার মনে হলো, ছেলে যদি নাটকটা পড়ে প্রয়োজনে সংশোধন করে দেয় তাহলে দুর্দান্ত একটা কাজ হবে। ছেলেও বাবার নাটক সংশোধনের সুযোগ পেয়ে এটাকে এমন কাটাকুটি করল যে, ওইটা আর ওর বাপের নাটক থাকেনি। ছেলের সংশোধিত ওই নাটক পড়ে ওর বাবা মহাখুশি, দারুণ হয়েছে। নাটকটা বেতারে জমা দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ সব শেষ করে দিল। ওই নাটক আর প্রচার হয়নি এবং আমাদের কাছে নাটকটার কোনো কপি নেই। ওদের বাবার একটা উপন্যাস আছে, বগুড়ায় থাকাকালে নিজের খরচে একটা উপন্যাস প্রকাশ করেছিল, উপন্যাসের নাম ‘দীপ নেভা যার ঘরে’। আমার মনে হয়, ছেলেরা চেষ্টা করলে ওই উপন্যাসটা প্রকাশের উদ্যোগ নিতে পারে।
হুমায়ূনের ‘শঙ্খনীল কারাগার’ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এত কথা বলে ফেললাম। সবাই জানে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, ‘নন্দিত নরকে’ ওর দ্বিতীয় উপন্যাস, যা প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল। ওর প্রথম উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’। ছুটিতে পিরোজপুরে এসে একটা নীল খাতায় উপন্যাসটা লিখেছিল হুমায়ূন। এখন সে তার বাবাকে উপন্যাসটা পড়াতে চায়। উপায় কী? ওর বাবার অফিস ছিল বাসারই একটি রুমে। হুমায়ূন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটা গোপনে ওর বাবার ফাইলপত্রের ভেতরে রেখে এল। রশিদ নামের একজন পাংখাপুলার কাজ করত তখন। রশিদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হলো, ওর বাবা উপন্যাসটা পড়েছেন কি না সেটা জানানো। রশিদ জানাল, ওর বাবা হুমায়ূনের উপন্যাসটা পড়েছে। ছেলের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। কারণ, দুপুরে খেতে এসে ওর বাবা নীলখাতায় পাওয়া উপন্যাস নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। আমার এখনো ওই দৃশ্যটা মনে আছে, সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ শেষ করে ওর বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে বলল, ‘আল্লাহপাক তোমার বড় ছেলেকে লেখক বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি শেষ হয়ে গেলে হুমায়ূন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি ফেলে বাক্সভর্তি কেমিস্ট্রির বই নিয়ে ঢাকায় ফিরে গেল। অনেক পরে বই হিসেবে ‘শঙ্খনীল কারাগার’ প্রকাশিত হয়েছে, পাঠকের মনে প্রবল আলোড়ন তৈরি করেছে। সরকারি উদ্যোগে সেই বই নিয়ে সিনেমা হয়েছে, সেই সিনেমা দেশের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছে। এই সব কিছু আমার ঊনিশ বছরের ছেলেটা যেমন জানত না, তেমনি জানতাম না আমরাও।"
হুমায়ূন আহমেদ স্যার, বাংলা ভাষার সাথে সাথে আপনার নাম ও অবদান থাকবে অম্লান।
এ সপ্তাহে পড়ুয়ায় যেসকল লেখা প্রকাশিত হয়েছে;